ষোড়শী কহিল, এখনও ত তাদের আসবার সময় হয়নি। বলিয়া সে হাতের বোতল দু’টা শয্যার একধারে রাখিয়া দিল।
জীবানন্দ কথাটাকে ঠিক যেন বিশ্বাস করিতে পারিল না; কহিল, এখনও আসবার সময় হয়নি? ডাক্তার কতদূরে থাকেন জানো?
ষোড়শী কহিল, জানি, কিন্তু পনর মিনিটের মধ্যেই কি আসা যায়?
জীবানন্দ নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, সবে পনর মিনিট? আমি ভেবেছি দু’ঘণ্টা তিন ঘণ্টা, কি আরও কতক্ষণ যেন এককড়ি তাঁকে আনতে গেছে। হয়ত তিনিও ভয়ে এখানে আসবেন না অলকা! বলিয়া সে চুপ করিয়া আবার উপুড় হইয়া শুইল। তাঁর কণ্ঠস্বরে এবং চোখের দৃষ্টিতে ব্যাকুল নিরাশ্বাসের কোথাও যেন আর শেষ রহিল না।
ষোড়শী ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া স্নিগ্ধস্বরে কহিল, ডাক্তার আসবেন বৈ কি। গরম জলের বোতল ততক্ষণ কেন টেনে নিন না?
জীবানন্দ তেমনিভাবেই মাথা নাড়িয়া বলিল, না, ও থাক। ওতে আমার কিছু হয় না, কেবল কষ্ট বাড়ে।
ষোড়শী সহসা কোন প্রতিবাদ করিল না। এই উপায়হীন রোগগ্রস্ত লোকটির মুখ হইতে তাহার নিজের শিশুকালের নামটা এতক্ষণ পরে যেন এই প্রথম তাহার কানে কানে গুন্গুন্ করিয়া কি একটা অজানা রহস্যের অর্থ বলিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। বোধ হয় ইহাতেই মগ্ন হইয়া সে নিজের ও পরের, সুমুখের ও পশ্চাতের সমস্তই ভুলিয়া গিয়া অভিভূতের ন্যায় দাঁড়াইয়া ছিল, হঠাৎ জীবানন্দের প্রশ্নেই তাহার হুঁশ হইল।
অলকা!
নামটাকে আর সে উপেক্ষা করিতে পারিল না। কহিল, আজ্ঞে?
জীবানন্দ বলিল, এখনও সময় হয়নি? হয়ত তিনি আসবেন না, হয়ত কোথাও চলে গেছেন।
ষোড়শী কহিল, আমি নিশ্চয় জানি, তিনি আসিবেন—তিনি কোথাও যাননি।
বাড়িতে কেউ কি এখনও ফিরে আসেনি?
ষোড়শী বলিল, না।
জীবানন্দ একমুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, বোধ হয় তারা আর আসবে না, বোধ হয় এককড়িও একটা ছল করে চলে গেল।
ষোড়শী মৌন হইয়া রহিল। জীবানন্দ নিজেও বোধ হয় একটা ব্যথা সামলাইয়া লইয়া একটু পরেই বলিল, সবাই গেছে, তারা যেতে পারে—কেবল তোমারই যাওয়া হবে না।
কেন?
বোধ করি আমি বাঁচব না—তাই। আমার নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে, মনে হচ্চে, পৃথিবীতে আর বুঝি হাওয়া নেই।
আপনার কি বড্ড কষ্ট হচ্ছে?
হুঁ। অলকা, আমাকে মাপ কর।
ষোড়শী নির্বাক হইয়া রহিল। জীবানন্দ একটু থামিয়া পুনরায় কহিল, আমি ঠাকুর-দেবতা মানিনে, দরকারও হয় না; কিন্তু একটু আগেই মনে মনে ভাবছিলুম। জীবনে অনেক পাপ করেচি, তার আর আদি-অবধি নেই। আজ থেকে থেকে কেবলি মনে হচ্চে বুঝি সব দেনা মাথায় নিয়ে যেতে হবে।
ষোড়শী তেমনি নীরবেই দাঁড়াইয়া রহিল। জীবানন্দ কহিল, মানুষ অমরও নয়, মৃত্যুর বয়সও কেউ দাগ দিয়ে রাখেনি, কিন্তু এই যন্ত্রণা আর সইতে পারচি নে—উঃ—মাগো! বলিতে বলিতে তাহার সর্বশরীর ব্যাটার অসহ্য তীব্রতায় যেন কুঞ্চিত হইয়া উঠিল।
ষোড়শী চাহিয়া দেখিল তাহার কেবল দেহই নয়, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দিয়াছে এবং বিবর্ণমুখে দুই নিমীলিত চক্ষের নীচে রক্তহীন ওষ্ঠাধর একটা অত্যন্ত কঠিন রেখায় সংবদ্ধ হইয়া গেছে।
পলকের জন্য কি একটা সে ভাবিয়া লইল, বোধ হয় একবার একটু দ্বিধাও করিল; তার পরে এই পীড়িতের শয্যায় হতভাগ্যের পার্শ্বে গিয়া উপবেশন করিল। গরম জলের বোতল-দু’টা সাবধানে তাহার পেটের কাছে টানিয়া দিতে জীবানন্দ কেবল ক্ষণিকের জন্য একবার চোখ মেলিয়াই আবার মুদ্রিত করিল। ষোড়শী আঁচল দিয়া তাহার ললাটের স্বেদ মুছাইয়া দিল, এবং হাতপাখার অভাবে সেই অঞ্চলটাই জড় করিয়া ধীরে ধীরে বাতাস করিতে লাগিল।
জীবানন্দ কোন কথা কহিল না, কেবল তাহার ডান হাতটা ধীরে ধীরে তুলিয়া ষোড়শীর ক্রোড়ের উপর রাখিয়া নিঃশব্দে পড়িয়া রহিল।
মিনিট দশ-পনর এমনি নীরবে কাটিবার পরে জীবানন্দই প্রথমে কথা কহিল। ডাকিল, অলকা!
ষোড়শী কহিল, আপনি আমাকে ষোড়শী বলে ডাকবেন।
আর কি অলকা হতে পারো না?
না।
কোনদিন কোন কারণেই কি—
আপনি অন্য কথা বলুন।
কিন্তু অন্য কথা জীবানন্দের মুখ দিয়া আর বাহির হইল না, শুধু নিবারিত দীর্ঘশ্বাসের শেষ বাতাসটুকু তাহার বক্ষের সম্মুখটাকে ঈষৎ বিস্ফারিত করিয়া দিয়া শূন্যে মিলাইল।
মিনিট দুই-তিন পরে ষোড়শী মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, আপনার কষ্টটা কিছুই কমেনি?
জীবানন্দ ঘাড় নাড়িয়া বলিল, বোধ হয় একটু কমেচে। আচ্ছা, যদি বাঁচি, তোমার কি কোন উপকার করতে পারিনে?
ষোড়শী বলিল, না, আমি সন্ন্যাসিনী—আমার নিজের কোনও উপকার করাই কারও সম্ভব নয়।
জীবানন্দ কিছুক্ষণ স্থির থাকিয়া হঠাৎ বলিয়া উঠিল, আচ্ছা, এমন কিছুই কি নেই, যাতে সন্ন্যাসিনীও খুশী হয়?
ষোড়শী কহিল, তা হয়ত আছে, কিন্তু সেজন্য কেন আপনি ব্যস্ত হচ্ছেন?
জীবানন্দ এইবার একটুখানি ক্ষীণ হাসি হাসিয়া কহিল, আমার ঢের দোষ আছে, কিন্তু পরের উপকার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, এ দোষ আজও কেউ আমাকে দেয়নি। তা ছাড়া এখন বলচি বলেই যে ভাল হয়েও বলবো, তারও কোন নিশ্চয়তা নেই—এমনই বটে! এমনই বটে! সারাজীবনে এ ছাড়া আর আমার কিছুই বোধ হয় নেই।
ষোড়শী নীরবে আর একবার তাহার কপালের ঘাম মুছাইয়া দিল। জীবানন্দ হঠাৎ সেই হাতটা ধরিয়া ফেলিয়া কহিল, সন্ন্যাসিনীর কি সুখদুঃখ নেই? সে খুশী হয়, পৃথিবীতে এমন কি কিছুই নেই?
ষোড়শী বলিল, কিন্তু সে ত আপনার হাতের মধ্যে নয়!
জীবানন্দ বলিল, যা মানুষের হাতের মধ্যে? তেমন কিছু?