পুলিশের সম্পর্কীয় সকলেই যথার্থ বিদায় গ্রহণ করিল, কিংবা কোথাও কেহ লুকাইয়া রহিয়া গেল, এ-বিষয় নিঃসংশয় হইতে ধূর্ত এককড়ি পা টিপিয়া নিঃশব্দে বাহির হইয়া গেলে জীবানন্দ ইঙ্গিত করিয়া ষোড়শীকে আর একটু নিকটে আহ্বান করিয়া অতিশয় ক্ষীণকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, তুমি এঁদের সঙ্গে গেলে না কেন?
ষোড়শী কহিল, এঁদের সঙ্গে ত আমি আসিনি।
জীবানন্দ কয়েক মুহূর্ত নীরবে থাকিয়া বলিল, তোমার বিষয়ের ছাড় লিখে দিতে দু’-চার দিন দেরি হবে, কিন্তু টাকাটা কি তুমি আজই নিয়ে যাবে?
ষোড়শী কহিল, তাই দিন।
জীবানন্দ শয্যার এক নিভৃত প্রদেশে হাত দিয়া একতাড়া নোট টানিয়া বাহির করিল। সেইগুলা গণনা করিতে করিতে ষোড়শীর মুখের প্রতি বার বার চাহিয়া দেখিয়া একটুখানি হাসিয়া কহিল, আমার কিছুতে লজ্জা করে না, কিন্তু আমারও এগুলো তোমার হাতে তুলে দিতে বাধ-বাধ ঠেকচে।
ষোড়শী শান্ত-নম্রকণ্ঠে বলিল, কিন্তু তাই ত দেবার কথা ছিল।
জীবানন্দের পাংশু মুখের উপর ক্ষণিকের জন্য লজ্জার আরক্ত আভা ভাসিয়া গেল, কহিল, কথা যাই থাক ষোড়শী, আমাকে বাঁচাতে তুমি যা খোয়ালে, তার দাম টাকায় ধার্য করচি, এ মনে করার চেয়ে বরঞ্চ আমার না বাঁচাই ছিল ভাল।
ষোড়শী তাহার মুখের উপর দুই চক্ষুর অচপল দৃষ্টি স্থির রাখিয়া কহিল, কিন্তু মেয়েমানুষের দাম ত আপনি এই দিয়েই চিরদিন ধার্য করে এসেছেন।
জীবানন্দ নিরুত্তরে বসিয়া রহিল।
ষোড়শী কহিল, বেশ, আজ যদি সে মত আপনার বদলে থাকে, টাকা না হয় রেখে দিন, আপনাকে কিছুই দিতে হবে না। কিন্তু আমাকে কি সত্যিই এখনো চিনতে পারেন নি? ভাল করে চেয়ে দেখুন দিকি?
জীবানন্দ নীরবে চাহিয়া রহিল, বহুক্ষণ পর্যন্ত তাহার চোখে পলক পর্যন্ত পড়িল না। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়া কহিল, বোধ হয় পেরেছি। ছেলেবেলায় তোমার নাম অলকা ছিল না?
ষোড়শী হাসিল না, কিন্তু তাহার সমস্ত মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, কহিল, আমার নাম ষোড়শী। ভৈরবীর দশমহাবিদ্যার নাম ছাড়া আর কোন নাম থাকে না, কিন্তু অলকাকে আপনার মনে আছে?
জীবানন্দ নিরুৎসুক-কণ্ঠে বলিল, কিছু কিছু মনে আছে বৈ কি। তোমার মায়ের হোটেলে যখন মাঝে মাঝে খেতে যেতাম, তখন তুমি ছ-সাত বছরের মেয়ে; কিন্তু আমাকে ত তুমি অনায়াসে চিনতে পেরেচ!
এই কণ্ঠস্বর ও তাহার নিগূঢ় অর্থ অনুভব করিয়া ষোড়শী কিছুক্ষণ নিরুত্তরে থাকিয়া অবশেষে সহজভাবে বলিল, তার কারণ অলকার বয়স তখন ছ-সাত নয়, ন-দশ বৎসর ছিল; এবং আপনার মনেও হতে পারে তার মা তাকে আপনার বাহন বলে পরিহাস করতেন। তা ছাড়া আপনার মুখের আর যত বদলই হোক, ডান চোখের ওই তিলটির কখনো পরিবর্তন হবে না। অলকার মাকে মনে পড়ে?
জীবানন্দ কহিল, পড়ে। তাঁর সম্বন্ধে তারাদাস যা বলতে বলতে গেল তাও বুঝতে পারচি। তিনি বেঁচে আছেন?
না। বছর-দশেক পূর্বে তাঁর কাশীলাভ হয়েচে। আপনাকে তিনি বড় ভালবাসতেন, না?
জীবানন্দর শীর্ণ মুখের উপর এবার উদ্বেগের ছায়া পড়িল, কহিল, হাঁ। একবার বিপদে পড়ে তাঁর কাছে একশ’ টাকা ধার নিয়েছিলাম, সেটা বোধ হয় আর শোধ দেওয়া হয়নি।
সহসা ষোড়শীর ওষ্ঠাধর চাপা হাসিতে ফুলিয়া উঠিল, কিন্তু সে তৎক্ষণাৎ তাহা সংবরণ করিয়া লইয়া সহজভাবে কহিল, আপনি সে জন্যে কোন ক্ষোভ মনে রাখবেন না। অলকার মা সে টাকা ধার বলে আপনাকে দেননি, যৌতুক বলেই দিয়েছিলেন। ক্ষণকাল চুপ করিয়া পুনশ্চ কহিল, আজ অপর্যাপ্ত সম্পদের দিনে সে-সব দুঃখের কথা হয়ত মনে হতে চাইবে না, হয়ত সেদিনের একশ’ টাকার মূল্য আজ হিসেব করাও কঠিন হবে, কিন্তু চেষ্টা করলে এটুকু মনেও পড়তে পারে যে, সে দিনটাও ঠিক এমনি দুর্দিনই ছিল। আজ ষোড়শীর ঋণটাই খুব ভারী বোধ হচ্চে, কিন্তু সেদিন ছোট্ট অলকার কুলটা মায়ের ঋণটাও কম ভারী ছিল না।
জীবানন্দ আহত হইয়া কহিল, তাই মনে করতে পারতাম যদি না তিনি ওই ক’টা টাকার জন্য তাঁর মেয়েকে বিবাহ করতে আমাকে বাধ্য করতেন।
ষোড়শী কহিল, বিবাহ করতে তিনি বাধ্য করেন নি, বরঞ্চ করেছিলেন আপনি! কিন্তু থাক্ ও-সব বিশ্রী আলোচনা। আপনাকে ত এইমাত্র বলেচি, আজ আর সেই তুচ্ছ টাকা ক’টার মূল্য-নিরূপণ সম্ভব হবে না, কিন্তু ওইমাত্র ছিল অলঙ্কার মায়ের জীবনের সঞ্চয়। মেয়ের কোন একটা সদ্গতি করবার ও-ছাড়া আর কিছু যখন তাঁর হাতে ছিল না, তখন টাকা-ক’টির সঙ্গে মেয়েটাকেও আপনারই হাতে দিতে হলো। কিন্তু বিবাহ ত আপনি করেন নি, করেছিলেন শুধু একটু তামাশা। সম্প্রদানের সঙ্গে সঙ্গেই সেই যে নিরুদ্দেশ হলেন, এই বোধ হয় তারপরে কাল প্রথম দেখা।
জীবানন্দ কহিল, কিন্তু তারপরে ত তোমার সত্যিকারের বিবাহই হয়েচে শুনেচি।
ষোড়শী ধৈর্য হারাইল না। তেমনি শান্ত গাম্ভীর্যের সহিত কহিল, তার মানে আর একজনের সঙ্গে? এই না? কিন্তু নিরপরাধ নিরুপায় বালিকার ভাগ্যে এ বিড়ম্বনা যদি ঘটেই থাকে, তবু ত আপনার সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই।
জীবানন্দ কুণ্ঠিত হইয়া কহিল, ষোড়শী, তখন তুমি ছেলেমানুষ ছিলে, অনেক কথাই ঠিক জানো না। তোমার মা যদি আজ বেঁচে থাকতেন, তিনি সাক্ষী দিতেন—তিনি সত্যি কি চেয়েছিলেন। তোমার বাবাকে আজকের পূর্বে কখনো দেখিনি, কেবল সেই সম্প্রদানের রাত্রে নামটা মাত্র শুনেছিলাম। কিন্তু তিনিই যে তারাদাস, তুমিই যে অলকা, সে আমি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি।