বিজয়া হাসিমুখে বলিল, তা হোক গণ্ডগোল—তিন দিন বৈ ত নয়! আর আপনি আমার অসুবিধের ভাবনা ভাবচেন—কিন্তু কলকাতা হলে কি করতেন বলুন ত? সেখানে অষ্টপ্রহর কেউ কানের পাশে তোপ দাগতে থাকলেও ত চুপ করে সহ্য করতে হতো? বলিয়া আগন্তুক যুবকটির পানে চাহিয়া কহিল, আপনার মামাকে জানাবেন, তিনি প্রতিবার যেমন করেন, এবারেও তেমনি পূজো করুন, আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই।
আগন্তুক এবং বিলাসবাবু উভয়েই বিস্ময়ে অবাক হইয়া বিজয়ার মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল।
আপনি তবে এখন আসুন, বলিয়া বিজয়া হাত তুলিয়া ক্ষুদ্র একটি নমস্কার করিল। অপরিচিত ভদ্রলোকটিও আপনাকে সংবরণ করিয়া লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল এবং ধন্যবাদ ও প্রতি-নমস্কার করিয়া এবং বিলাসকেও একটি নমস্কার করিয়া ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল। অবশ্য ক্রুদ্ধ বিলাস আর একদিকে চক্ষু ফিরাইয়া তাহা অগ্রাহ্য করিল; কিন্তু দুজনের কেহই জানিতে পারিল না যে, এই অপরিচিত যুবকটিই তাহাদের সর্বপ্রধান আসামী জগদীশের পুত্র নরেন্দ্রনাথ।
দত্তা – ০৫-০৬
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
সে চলিয়া গেলে, মিনিট-খানেক বিজয়া অন্যমনস্ক ও নীরব থাকিয়া সহসা চকিত হইয়া মুখ তুলিতেই, নিতান্ত অকারণেই তাহার কপোলের উপর একটা ক্ষীণ আরক্ত আভা দেখা দিল। বিলাসের দৃষ্টি অন্যত্র নিবদ্ধ না থাকিলে তাহার বিস্ময় ও অভিমানের হয়ত পরিসীমা থাকিত না। বিজয়া মৃদু হাসিয়া কহিল, আমাদের কথাটা যে শেষ হতেই পেলে না। তা হলে তালুকটা নেওয়াই আপনার বাবার মত?
বিলাস জানালার বাহিরে চাহিয়াছিল—সেইভাবেই কহিল, হুঁ।
বিজয়া জিজ্ঞাসা করিল, কিন্তু এর মধ্যে কোন রকম গোলমাল নেই ত?
বিলাস বলিল, না।
বিজয়া পুনরায় প্রশ্ন করিল, আজ কি তিনি ও-বেলায় এদিকে আসবেন?
বিলাস কহিল, বলতে পারিনে।
বিজয়া হাসিয়া কহিল, আপনি রাগ করলেন নাকি?
এবার বিলাস মুখ ফিরাইয়া গম্ভীরভাবে জবাব দিল, রাগ না করলেও পিতার অপমানে পুত্রের ক্ষুণ্ণ হওয়া বোধ করি অস্বাভাবিক নয়।
কথাটা বিজয়াকে আঘাত করিল, তবু সে হাসিমুখেই কহিল, কিন্তু এতে তাঁর মানহানি হয়েছে—এ ভুল ধারণা আপনার কি করে জন্মাল? তিনি স্নেহবশে মনে করেছেন, আমার কষ্ট হবে, কিন্তু কষ্ট হবে না এইটেই শুধু ভদ্রলোককে জানিয়ে দিলুম। এতে মান-অপমানের কথা ত কিছুই নেই বিলাসবাবু!
বিলাসের গাম্ভীর্যের মাত্রা তাহাতে বিন্দুমাত্র কমিল না; সে মাথা নাড়িয়া উত্তর দিল, ওটা কথাই নয়। বেশ, আপনার এস্টেটের দায়িত্ব নিজে নিতে চান, নিন, কিন্তু এর পরে বাবাকে আমায় সাবধান করে দিতেই হবে, নইলে পুত্রের কর্তব্যে ত্রুটি হবে।
এই অচিন্তনীয় রূঢ় প্রত্যুত্তরে বিজয়া বিস্ময়ে অবাক হইয়া রহিল; এবং কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে থাকিয়া অত্যন্ত ব্যথার সহিত কহিল, বিলাসবাবু, এই সামান্য বিষয়টাকে যে আপনি এমন করে নিয়ে এত গুরুতর করে তুলবেন, এ আমি মনেও করিনি। ভাল, আমার বোঝবার ভুলে যদি অন্যায়ই হয়ে থাকে, আমি অপরাধ স্বীকার করছি, ভবিষ্যতে আর হবে না। এই বলিয়া বিজয়া বিলাসের মুখের প্রতি চাহিয়া একটা নিশ্বাস ফেলিল। সে ভাবিয়াছিল, ইহার পরে কাহারও কোন কথাই আর থাকিতে পারে না—দোষ-স্বীকারের সঙ্গে সঙ্গেই তাহার সমাপ্তি হইয়া যায়। কিন্তু এ সংবাদ তাহার জানা ছিল না যে, দুষ্ট ব্রণের মত এমন মানুষও আছে, যাহার বিষাক্ত ক্ষুধা একবার কাহারও ত্রুটির মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করিলে আর কোন মতেই নিবৃত্ত হইতে চাহে না। তাই বিলাস যখন প্রত্যুত্তরে কহিল, তা হলে পূর্ণ গাঙ্গুলীকে জানিয়ে পাঠান যে রাসবিহারীবাবু যে হুকুম দিয়েছেন, তার অন্যথা করা আপনার সাধ্য নয়, তখন বিজয়ার দৃষ্টির সম্মুখে এই লোকটির হিংস্র প্রকৃতিটা একমুহূর্তেই একেবারে পরিস্ফুট হইয়া দেখা দিল।
সে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে চাহিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে কহিল, সেটা কি ঢের বেশী অন্যায় কাজ হবে না? আচ্ছা, আমি নিজেই নাহয় চিঠি লিখে তাঁর অনুমতি নিচ্চি।
বিলাস বলিল, এখন অনুমতি নেওয়া-না-নেওয়া দুই-ই সমান। আপনি যদি তাঁকে সমস্ত গ্রামের মধ্যে অশ্রদ্ধার পাত্র করে তুলতে চান, আমাকেও তা হলে অত্যন্ত অপ্রিয় কর্তব্য পালন করতে হবে।
বিজয়ার অন্তরটা অকস্মাৎ ক্রোধে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল; কিন্তু সে আত্মসংযম করিয়া ধীরভাবে প্রশ্ন করিল, এই কর্তব্যটা কি শুনি?
বিলাস বলিল, আপনার জমিদারি শাসনের মধ্যে তিনি যেন আর হাত না দেন।
আপনার নিষেধ তিনি শুনবেন, আপনি মনে করেন?
অন্ততঃ সেই চেষ্টাই আমাকে করতে হবে।
বিজয়া ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া অন্য দিকে চাহিয়া, তেমনি শান্তকণ্ঠেই জবাব দিল, বেশ, আপনি যা পারেন করবেন; কিন্তু অপরের ধর্ম-কর্মে আমি বাধা দিতে পারব না।
তাহার কণ্ঠস্বরের মৃদুতা সত্ত্বেও তাহার ভিতরের ক্রোধ গোপন রহিল না। বিলাস তীব্রকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, আপনার বাবা কিন্তু এ কথা বলতে সাহস করতেন না।
বিজয়া ফিরিয়া দাঁড়াইয়া চোখ তুলিয়া তাহার মুখের প্রতি চাহিল; কহিল, আমার বাবার কথা আপনার চেয়ে আমি ঢের বেশী জানি বিলাসবাবু। কিন্তু সে নিয়ে তর্ক করে কি হবে? আমার স্নানের বেলা হল, আমি উঠলুম। বলিয়া সে সমস্ত বাগ্বিতণ্ডা জোর করিয়া বন্ধ করিয়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইবামাত্রই ক্রোধোন্মত্ত বিলাসের মুখের উপর হইতে তাহার ধার-করা ভদ্রতার মুখোশ একমুহূর্তে খসিয়া পড়িল। সে নিজেও স্বভাবটাকে একেবারে অনাবৃত উলঙ্গ করিয়া দিয়া, নিরতিশয় কটুকণ্ঠে বলিয়া ফেলিল, মেয়েমানুষ জাতটাই এমনি নেমকহারাম।