পিতৃদেব চলিয়া গেলে বিলাস আর একবার গম্ভীর এবং কাঠের মত শক্ত হইয়া দাঁড়াইয়া বলিল, আমি জানি আমাকে তুমি ভালবাস না। কিন্তু, সাধারণ লোকের মত আমিও যদি সেই ভালবাসাকেই ঊর্ধ্বে স্থান দিতাম, তা হলে আজ মুক্তকণ্ঠে বলে যেতাম—বিজয়া, তুমি যাকে ভালবেসেচ, তাকেই বরণ কর! আমার মধ্যে সে শক্তি, সে উদারতা, সে ত্যাগ আছে! বাবার কাছে আমি আজীবন মিথ্যা শিক্ষা পেয়ে আসিনি।
মুহূর্তকাল স্তব্ধ থাকিয়া পুনশ্চ কহিতে লাগিল, কিন্তু, একটা সকাম রূপ-তৃষ্ণা, যাকে ভালবাসা বলে মানুষ ভুল করে, সেই কি ব্রাহ্ম-কুমার-কুমারীর বিবাহের চরম লক্ষ্য? না, তা কিছুতেই নয়, কিছুতেই হতে পারে না। এই বিরাট উদ্দেশ্য সত্য! মুক্তি! পরব্রহ্মপদে যুগ্ম আত্মার একান্ত আত্মসমর্পণ! আমি বলচি তোমাকে, একদিন আমার কাছে এ সত্য তুমি বুঝবেই বুঝবে। এই নরেন যখন আসেনি, তখনকার কথাগুলো একবার স্মরণ কর দেখি বিজয়া!
কি একটা বলিবার জন্য বিজয়া মুখ তুলিল, কিন্তু তাহার ওষ্ঠাধর কাঁপিয়া উঠিয়া প্রবল বাষ্পোচ্ছ্বাসে বাক্রোধ হইয়া গেল—মুখ দিয়া কোন কথাই বাহির হইল না। সে শুধু কেবল হাত দুটি কপালে তুলিয়া একটা নমস্কার করিয়াই পাশের দরজা দিয়া দ্রুতবেগে পলায়ন করিল।
দত্তা – ২৫ – ২৬ (শেষ)
পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ
নিদারুণ সংশয়ের বেড়া-আগুনের মধ্যে বিজয়ার চিত্ত যে কতদূর পীড়িত এবং উদ্ভ্রান্ত হইয়া উঠিয়াছিল, তাহা আপনাকে চূড়ান্তভাবে সমর্পণ করিয়া না দেওয়া পর্যন্ত সে ঠিকমত বুঝিতে পারে নাই। আজ সকালে ঘুম ভাঙ্গিয়াই বুঝিল, তাহার মন খুব শান্ত হইয়া গেছে। কারণ, মনের মধ্যে চাঞ্চল্যের আভাসটুকুও খুঁজিয়া পাইল না। বাহিরে চাহিতে মনে হইল সমস্ত আকাশটা যেন শ্রাবণ-প্রভাতের মত ধূসর মেঘের ভারে পৃথিবীর উপর হুমড়ি খাইয়া পড়িয়াছে। এমন দিনে শয্যাত্যাগ করা না-করা তাহার সমান বলিয়া বোধ হইল, এবং কেন যে অন্যান্য দিন সকালে ঘুম ভাঙ্গিতে সামান্য বেলা হইলেও অন্তঃকরণ ব্যথিত লজ্জিত হইয়া উঠিত—মনে হইত, অনেক সময় নষ্ট হইয়া গেছে, আজ তাহা ভাবিয়াই পাইল না। তাহার এমন কি কাজ আছে যে, দু-একঘণ্টা বিছানায় পড়িয়া থাকিলে চলে না! বাটীতে দাস-দাসী ভরা, বৃহৎ জমিদারি সুশৃঙ্খলায় চলিতেছে, তাহার সমস্ত ভবিষ্যৎ জীবন যদি এমনি আরামে, এমনি শান্তিতে কাটিয়া যায়, ত তার চেয়ে আর ভাল জিনিস কি আছে? জানালা দিয়া চাহিয়া দেখিল গাছতলার সবুজ রঙটা পর্যন্ত আজ কি একরকম বদলাইয়া গিয়া তাহার পাতাগুলা পর্যন্ত স্থির গম্ভীর হইয়া উঠিয়াছে। কলহ-বিবাদ, তর্ক-বিতর্ক, অশান্তি-উপদ্রব বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কোথাও আর কিছু নাই—একটা রাত্রির মধ্যেই সমস্ত যেন একেবারে মুনি-ঋষির তপোবন হইয়া উঠিয়াছে।
হৃদয়জোড়া এই চরম অবসাদকে শান্তি কল্পনা করিয়া বিজয়া পক্ষাঘাতগ্রস্তের মত হয়ত আরও বহুক্ষণ বিছানায় পড়িয়া থাকিতে পারিত, কিন্তু পরেশের মা আসিয়া দ্বারপ্রান্ত হইতে শান্তিভঙ্গ করিয়া দিল। যে লোক প্রত্যুষেই শয্যাত্যাগ করে, তাহার পক্ষে এতখানি বেলায়—সে উৎকণ্ঠিতচিত্তে বারংবার ডাকাডাকি করিয়া কপাট খোলাইয়া তবে ছাড়িল।
হাতমুখ ধুইয়া কাপড় ছাড়িয়া প্রস্তুত হইয়া বিজয়া নীচে নামিতেছিল; শুনিল, বাহিরে রাসবিহারী আজ স্বয়ং আসিয়া জনমুজরদের কার্যের তত্ত্বাবধান করিতেছেন। মাত্র দুটি দিন আর বাকী, এইটুকু সময়েই সমস্ত বাড়িটাকে মাজিয়া ঘষিয়া একেবারে নূতন করিয়া তুলিতে হইবে।
বিজয়া একটু পূর্বেই ভাবিয়াছিল, গতরাত্রে যে দুরূহ সমস্যার শেষ এবং চরম নিষ্পত্তি হইয়া গিয়াছে, কোনও কারণে কাহারও দ্বারা যাহার অন্যথা ঘটিতে পারে না, তাহার ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ লইয়া আর সে মনে মনেও কখনো বিতর্ক করিবে না। তাহা মঙ্গলময়ের ইচ্ছায় মঙ্গলের জন্যেই হইয়াছে এ বিশ্বাসে সন্দেহের ছায়াটুকুও আর পড়িতে দিবে না। কিন্তু সহসা দেখিতে পাইল তাহা সম্ভব নয়। রাসবিহারী নীচে আছেন, নামিলেই মুখোমুখি সাক্ষাৎ হইয়া যাইবে ইহা মনে করিতেই তাহার সর্বাঙ্গ বিমুখ হইয়া আপনিই সিঁড়ি হইতে ফিরিয়া আসিল।
বহুক্ষণ ধরিয়া বারান্দায় পায়চারি করিয়াও যখন সময় কাটিতে চাহিল না, তখন অকস্মাৎ তাহার বাল্যবন্ধুদের কথা মনে পড়িল। বহুকাল কাহারও সহিত দেখা- সাক্ষাৎ নাই, চিঠিপত্রও বন্ধ ছিল, আজ তাহাদিগকেই স্মরণ করিয়া সে কয়েকখানা পত্র লিখিবার জন্য তাহার পড়িবার ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল। মনের মধ্যে তাহার কত না বেদনা সঞ্চিত হইয়া ছিল। চিঠির মধ্যে দিয়া তাহাদিগকেই মুক্তি দিতে গিয়া সে দেখিতে দেখিতে একেবারে মগ্ন হইয়া গেল। কেমন করিয়া যে সময় কাটিল, কত যে অশ্রু ঝরিয়া পড়িল, তাহার কিছুই খেয়াল ছিল না। এমনি সময়ে পরেশের মা দ্বারের কাছে আসিয়া কহিল, বেলা যে একটা বেজে গেল দিদিমণি, খাবে না?
ঘড়ির প্রতি চাহিয়া পুনশ্চ লেখায় মনঃসংযোগ করিতে যাইতেছিল, পরেশের মা সলজ্জ মৃদুকণ্ঠে কহিল, ও মা, ডাক্তারবাবু আসচেন যে। বলিয়াই তাড়াতাড়ি সরিয়া গেল। বিজয়া চমকিয়া মুখ ফিরাইয়া দেখিল, ঠিক সোজা বারান্দার অপর প্রান্তে পরেশের পিছনে নরেন্দ্র আসিতেছে।
ইতিপূর্বে আরও কয়েকবার সে উপরে আসিলেও নিজের ইচ্ছায় এমন বিনা সংবাদে উঠিয়া আসিতে পারে, ইহা বিজয়া ভাবিতেও পারিত না। তাহার মুখ শুষ্ক, বড় বড় রুক্ষ চুল এলোমেলো; কিন্তু সে ঘরে পা দিয়াই যখন বলিয়া উঠিল, সেদিন আমাকে চিনতে চাননি কেন, বলুন ত? বলিয়া একটা চৌকি অধিকার করিয়া বসিল। তখন তাহার মুখে, তাহার কণ্ঠস্বরে, তাহার সর্বদেহে হৃদয়-ভারাক্রান্ত ক্লান্তি এমন করিয়াই আত্মপ্রকাশ করিল যে, বিজয়া জবাব দিবে কি, দুর্বিষহ বেদনায় একেবারে চমকিয়া গেল। উৎকণ্ঠিত ব্যগ্রতায় উঠিয়া দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনার কি হয়েছে নরেনবাবু? কোন অসুখ করেনি ত?