কিন্তু, রাসবিহারী তাহার গম্ভীর নির্বাক মুখের প্রতি চাহিয়া অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিলেন। কহিলেন, তা হলে মা—এ ঘরে কালি-কলম আছে, না নীচ থেকে আনতে বলে দেব?
বিজয়া চমকিয়া চাহিল। অতীতের কুৎসিত, কদাকার স্মৃতির উপরে তাহার চিন্তার ডোর ধীরে ধীরে একখানি সূক্ষ্ম জাল বুনিতে আরম্ভ করিয়াছিল, এই স্বার্থান্ধ বৃদ্ধের নিষ্ঠুর ব্যগ্রতা ছুরির মত পড়িয়া তাহাকে নিমেষে ছিন্নভিন্ন করিয়া আগাগোড়া অনাবৃত করিয়া দিল; এবং পরক্ষণেই বিজয়া একবারে মরিয়ার মত নির্দয় হইয়া কহিল, আচ্ছা জিজ্ঞাসা করি কাকাবাবু, আপনার কি এই মত যে, পাপ যতই বড় হোক, টাকার তলায় সমস্ত চাপা পড়ে যায়?
রাসবিহারী প্রশ্নের তাৎপর্য ঠিক ধরিতে না পারিয়া থতমত খাইয়া শুধু কহিলেন, কেন, কেন মা?
বিজয়া অবিচলিত দৃঢ়স্বরে বলিল, নইলে, আমার অতবড় পাপটাকে উপেক্ষা করে কি আপনি আমাকে গ্রহণ করতে চাইতেন?
রাসবিহারী লজ্জায় ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন। হতবুদ্ধির মত বলিলেন, সে ত মিথ্যে কথা। অতিবড় শত্রুও ত তোমাকে ও অপবাদ দিতে পারে না মা!
বিজয়া কহিল, শত্রু হয়ত পারে না। কিন্তু, আমি জিজ্ঞাসা করি, বিলাসবাবু কি আমাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতে পারবেন?
রাসবিহারী কহিলেন, শ্রদ্ধার চোখে দেখতে পারবে না। তোমাকে! বিলাস! আচ্ছা—বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে ডাকিতে লাগিলেন, বিলাস! বিলাস!
বিলাস নিকটে কোথাও বোধকরি প্রতীক্ষা করিতেছিল, ভিতরে আসিয়া দাঁড়াইল। রাসবিহারী বলিয়া উঠিলেন, শোন কথা বিলাস! আমার বিজয়া মা বলচেন তুমি কি তাঁকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতে পারবে? শোন একবার—
বিলাস সহসা কোন উত্তর দিতে পারিল না—প্রশ্নটা যেন সে বুঝিতেই পারিল না, এমনি ভাবে শুধু চাহিয়া রহিল।
বিজয়া কহিল, সেদিন কাকাবাবু বাড়ির চাকর-বাকরদের জিজ্ঞাসা করে আমাকে এসে বলেছিলেন যে, আমি অনেক রাত্রি পর্যন্ত নিভৃতে নরেনবাবুর সঙ্গে আমোদ-আহ্লাদ করেও তৃপ্ত হইনি; অবশেষে তিনি ট্রেন না পাবার অছিলায় সে রাত্রিটা এইখানে কাটিয়েই সকালবেলা চলে গিয়েছিলেন। এই অবস্থায়—
কথাটা রাসবিহারীর উচ্চকণ্ঠে চাপা পড়িয়া গেল। তিনি বার বার বলিতে লাগিলেন, কখ্খনো না! কখ্খনো না! এ যে অসম্ভব! এ যে ঘোর মিথ্যা—এ যে একবারেই—ইত্যাদি ইত্যাদি।
বিলাসের মুখ কালো হইয়া উঠিল। সে কহিল, না আমি শুনিনি।
রাসবিহারী আবার চেঁচাইতে লাগিলেন, কেমন করে শুনবে বিলাস—এ যে ভয়ানক মিথ্যা! এ যে দারুণ—তাই আমি দরোয়ান ব্যাটাকে—তুমি দেখো দিকি, পরেশ ছোঁড়াটাকে আমি কি রকম শাস্তি দিই! আমি—
বিলাস কহিল, পৃথিবী-সুদ্ধ লোক যদি এ কথার সাক্ষ্য দিত তবুও বিশ্বাস করতাম না।
বিজয়া কঠিন হইয়া প্রশ্ন করিল, কেন করতেন না? সে কি আমার বিষয়ের জন্যে?
রাসবিহারী এই কথার সূত্র ধরিয়া পুনরায় বকিতে শুরু করিয়াছিলেন; কিন্তু ছেলের মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া সহসা থামিয়া গেলেন।
বিলাসের দুই চক্ষু প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল, কিন্তু তাহার কণ্ঠস্বরে লেশমাত্র উচ্ছ্বাস বা উগ্রতা প্রকাশ পাইল না। শুধু শান্ত স্থির স্বরে জবাব দিল, না। তোমার বিষয়ের উপর আমার লেশমাত্র লোভ নেই।
সমস্ত কক্ষটা নিস্তব্ধ হইয়া রহিল; এবং এই নীরবতার ভিতর দিয়াই এতক্ষণে একই সঙ্গে সকলের যেন সমস্ত ব্যাপারটার কদর্য শ্রীহীনতা চোখে পড়িয়া গেল। এ যেন হাটের মধ্যে একটা বেচা-কেনার পণ্য লইয়া দুই পক্ষে তীব্র কঠোর দরদস্তুর চলিতেছিল। যাহাতে লজ্জা, শরম, শ্রী, শোভার কিছুমাত্র অবকাশ ছিল না—শুধু দুটা মানুষ এক উলঙ্গ স্বার্থের দুই দিকে দৃঢ়-মুষ্টিতে চাপিয়া পরস্পরের কাছে ছিনাইয়া লইবার জন্য প্রাণপণে টানা-হেঁচড়া করিতেছিল।
রাসবিহারী তাঁহার বহু ক্লেশার্জিত পরিণত বয়সের প্রশান্ত গাম্ভীর্য বিসর্জন দিয়া যেভাবে একটা ইতরের মত গণ্ডগোল চেঁচামেচি করিতেছিলেন, বিলাসের ভাষা ও সংযমের সম্মুখে সে ত্রুটি তাঁহাকেও যেমন বাজিল, বিজয়াও নিজের একান্ত লজ্জাহীন প্রগল্ভতায় মর্মে মরিয়া গেল। বিপদ যত গুরুতরই হোক, কোন ভদ্রমহিলাই যে এতদূর আত্মবিস্মৃত হইয়া আপনার চরিত্রকে মীমাংসার বিষয়ীভূত করিয়া পুরুষের সহিত এমন করিয়া মর্যাদাহীন বাদ-বিতণ্ডায় প্রবৃত্ত হইতে পারে, ক্ষণকালের জন্য এ যেন একটা অসম্ভব ব্যাপার বলিয়া তাহার বোধ হইল। মনে হইল, দাম্পত্য-জীবনের যত কিছু মাধুর্য, যত কিছু পবিত্রতা আছে সমস্তই যেন তাহার জন্য একেবারে উদ্ঘাটিত হইয়া ধূলায় লুটাইয়া পড়িল।
ঘরের নিবিড় নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া বিলাসই আবার কথা কহিল। বলিল, বিজয়া, বাবা যাই করুন, যাই বলুন, আমরা তাঁকে বুঝতে পারি না পারি—কিন্তু এই কথাটা আমাদের কোন মতে বিস্মৃত হওয়া উচিত নয়—যিনি ব্রহ্মপদে আত্মসমর্পণ করেছেন, তিনি কখনো অন্যায় করতে পারেন না। আমি বলচি তোমাকে, তোমাকে ছাড়া তোমার বিষয়-সম্পত্তির প্রতি আমাদের লেশমাত্র স্পৃহা নাই।
বিজয়া তাহার পাংশু মুখ ও মলিন চোখ দুটি বিলাসের মুখের ওপর ক্ষণকাল স্থাপিত করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, সত্যি বলচেন?
বিলাস অগ্রসর হইয়া আসিয়া বিজয়ার ডান হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া কহিল, আমার মধ্যে যদি কোন সত্য থাকে বিজয়া, আজ তা হলে আমি তোমাদের কাছে সত্য কথাই বলচি।
শুধু মুহূর্তকাল উভয়ে এইভাবে দাঁড়াইয়া থাকিয়া বিজয়া আস্তে আস্তে নিজের হাতখানি মুক্ত করিয়া লইয়া টেবিলের কাছে আসিয়া কলম তুলিয়া লইল। পলকের জন্য হয়ত একবার দ্বিধা করিল, হয়ত করিল না—কিছুই নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না—কিন্তু পরক্ষণেই বড় বড় অক্ষরে নিজের নাম সই করিয়া দিয়া কাগজখানি রাসবিহারীর হাতে আনিয়া দিয়া কহিল, এই নিন।
রাসবিহারী দলিলখানি ভাঁজ করিয়া পকেটে রাখিলেন, এবং উঠিয়া দাঁড়াইয়া বনমালীর শোকে অনেক অশ্রু ব্যয় করিয়া , এবং নিরাকার পরব্রহ্মের অসীম করুণার বিস্তর গুণগান করিয়া রাত্রি হইতেছে বলিয়া প্রস্থান করিলেন।