তিনি ভাবিতে নাই পারুন, কিন্তু তবুও ঠিক সেই সময়েই অন্যায় যে কোথায় এবং কতদূর পর্যন্ত পৌঁছিতেছিল সে শুধু অন্তর্যামীই জানিতেছিলেন।
উভয়ে যখন দয়ালের বসিবার ঘরে প্রবেশ করিলেন তখন সন্ধ্যার ছায়া ঘনাইয়া আসিয়াছে। একটা টেবিলের দু’দিকে দুখানা চেয়ারে বসিয়া নরেন্দ্র ও নলিনী। সম্মুখে খোলা বই। অক্ষর অস্পষ্ট হইয়া উঠায় পড়া ছাড়িয়া তখন ধীরে ধীরে আলোচনা শুরু হইয়াছিল। নলিনী এই দিকে চাহিয়া বসিয়াছিল, সে-ই বিজয়াকে প্রথমে দেখিতে পাইয়া কলকণ্ঠে সংবর্ধনা করিল। কিন্তু, বিজয়ার মুখ বেদনায় যে বিবর্ণ হইয়া গেল—তাহা সন্ধ্যার ম্লান আলোকে তাহার চোখে পড়িল না। নরেন্দ্র তাড়াতাড়ি চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া নমস্কার করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ভাল আছেন?
বিজয়া নমস্কারও ফিরাইয়া দিল না, প্রশ্নের উত্তরও দিল না। যেন দেখিতেই পায় নাই, এমনি ভাবে তাহার প্রতি সম্পূর্ণ পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইয়া নলিনীকে কহিল, কৈ, আপনি ত আর একদিনও গেলেন না?
নরেন সুমুখে আসিয়া হাসিমুখে কহিল, আর আমাকে বুঝি চিনতেও পারলেন না?
বিজয়া শান্ত অবজ্ঞার সহিত জবাব দিল, চিনতে পারলেই চেনা দরকার নাকি?
নলিনীকে কহিল, চলুন আপনার মামীমার সঙ্গে আলাপ করে আসি। বলিয়া পলকমাত্র এদিকে আর একবার দৃষ্টিপাত করিয়া তাহাকে একপ্রকার ঠেলিয়া লইয়া উপরে চলিয়া গেল।
নলিনী সিঁড়ির কয়েক ধাপ উপর হইতে ডাকিয়া কহিল, কিন্তু চা না খেয়ে যেন পালাবেন না নরেনবাবু।
নরেন ইহারও জবাব দিতে পারিল না—বিস্ময়ে, অপমানে একেবারে কাঠ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, এবং বৃদ্ধ দয়াল তাহার এই অপ্রত্যাশিত লজ্জার অংশ লইবার জন্য বিরসমুখে সেইখানেই নীরবে দাঁড়াইয়া রহিলেন। কিন্তু, তবুও কেমন করিয়া যেন তাঁহার কেবলি সন্দেহ হইতে লাগিল, যাহা বাহিরে প্রকাশ পাইল ইহা ঠিক সেই বস্তুই নয়—এই অকারণ অবমাননার অন্তরালে দৃষ্টির আড়ালে যাহা রহিয়া গেল তাহা আর যাহাই হোক উপেক্ষা অবহেলা নয়।
কিছু পরে চায়ের জন্যে উপরে ডাক পড়িলে আজ নরেন্দ্র দয়ালের অনুরোধ এড়াইয়া নীচেই রহিয়া গেল। কিন্তু তাহাকে একাকী ফেলিয়া দয়াল উপরে যাইতে পারিতেছেন না দেখিয়া তৎক্ষণাৎ সহাস্যে কহিল, আমি ঘরের লোক, আমার কথা ভাববেন না দয়ালবাবু। কিন্তু, আপনার মান্য অতিথিটির সম্মান রাখা আবশ্যক। আপনি শীঘ্র যান।
দয়াল দুঃখিত এবং লজ্জিতভাবে উপরে যাইবার উপক্রম করিয়া কহিলেন, তা হলে তুমি কি একটু বসবে?
ভৃত্য আলো দিয়া গিয়াছিল। নরেন খোলা বইটা কাছে টানিয়া লইয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিল, আজ্ঞে হাঁ, বসবো বৈ কি!
প্রায় আধঘণ্টা পরে আবার তিনজনে নীচে নামিয়া আসিলে নরেন বই রাখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। আজ না থাকিয়া চলিয়া গেলেই বোধ করি ইঁহারা আরাম অনুভব করিতেন, কারণ এই তাহার একাকী অপেক্ষা করাটাই সকলকে একসঙ্গে যেন লজ্জা ও কুণ্ঠার কশাঘাত করিল।
নলিনী সলজ্জ মৃদুকণ্ঠে কহিল, আপনার চা নীচে আনতে বলে দিয়েচি—এলো বলে নরেনবাবু!
কিন্তু বিজয়া তাহাকে কোনপ্রকার সম্ভাষণ না করিয়া, এমন কি দৃক্পাত পর্যন্ত না করিয়া ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল। কানাই সিং দ্বারের কাছে বসিয়া ছিল, লাঠি হাতে করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। বিজয়া বাহিরে আসিয়া দেখিল, আকাশে মেঘের আভাস পর্যন্ত নাই—নবমীর চাঁদ ঠিক সুমুখেই স্থির হইয়া আছে। তাহার মনে হইতে লাগিল পদতলের তৃণরাজি হইতে আরম্ভ করিয়া কাছে-দূরে যাহা-কিছু দেখা যায়—আকাশ-প্রান্তর, গ্রামান্তের বনরেখা, নদী, জল সমস্তই এই নিঃশব্দ জ্যোৎস্নায় দাঁড়াইয়া ঝিমঝিম করিতেছে। কাহারও সহিত কাহারও সম্বন্ধ নাই—পরিচয় নাই—কে যেন তাহাদের ঘুমের মধ্যে স্বতন্ত্র জগৎ হইতে ছিঁড়িয়া আনিয়া যেখানে সেখানে ফেলিয়া গেছে—এখন তন্দ্রা ভাঙিয়া তাহারা পরস্পরের অজানা মুখের প্রতি অবাক্ হইয়া তাকাইয়া আছে। চলিতে চলিতে তাহার চোখ দিয়া অবিরল জল পড়িতে লাগিল এবং মুছিতে মুছিতে বার বার বলিতে লাগিল, আমি আর পারি না, আমি আর পারি না।
বাড়ি আসিতেই খবর পাইল রাসবিহারী কি জন্য সন্ধ্যা হইতে বাহিরের ঘরে অপেক্ষা করিয়া আছেন। শুনিতেই তাহার চিত্ত তিক্ত হইয়া উঠিল, এবং কোন কথা না কহিয়া পাশের সিঁড়ি দিয়া উপরে নিজের ঘরে চলিয়া গেল। কিন্তু, ইহাও তাহার অবিদিত ছিল না যে শত বিলম্বেও এই পরম সহিষ্ণু লোকটির ধৈর্যচ্যুতি ঘটিবে না। তিনি প্রতীক্ষা করিয়া যখন আছেন, তখন, রাত্রি যত বেশী হোক, সাক্ষাৎ না করিয়া কোন মতেই নড়িবেন না।
অনতিকাল মধ্যেই দ্বারের উপর দাঁড়াইয়া পরেশ জানাইয়া দিল বড়বাবু আসিতেছেন, এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাঁহার চটিজুতার ও লাঠির শব্দ যুগপৎ শুনিতে পাওয়া গেল।
বিজয়া কহিল, আসুন।
ঘরে প্রবেশ করিয়া রাসবিহারী চৌকিতে উপবেশন করিয়া বলিলেন, আমি তাই এতক্ষণ এদের বলছিলাম যে, এতগুলো চাকর-বাকরের মধ্যে এ হুঁশ কারও হলো না যে, বাড়ি থেকে দুটো লন্ঠন নিয়ে যায়! দয়ালেরও এ ভয় হওয়া উচিত ছিল যে, মাঠের মধ্যে জ্যোৎস্নার আলোয় নির্ভর না করে সঙ্গে একটা আলো দেওয়া প্রয়োজন! তাই ভাবি, ভগবান! এ সংসারে আত্মীয়-পরে কী প্রভেদটাই তুমি করে রেখেচ! বলিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস মোচন করিলেন। কিন্তু, বিজয়া কিছুই কহিল না। তখন রাসবিহারী একবার কাশিয়া, একটু ইতস্ততঃ করিয়া পকেট হইতে একখানা কাগজ বাহির করিয়া বলিলেন, যা করবার সবই আমি করে রেখেচি; শুধু তোমার নামটা একটু লিখে দিতে হবে মা, এটা আবার কালকেই পাঠিয়ে দেওয়া চাই।
বলিয়া কাগজখানা বিজয়ার হাতে গুঁজিয়া দিলেন। বিজয়া দৃষ্টিপাতমাত্রই বুঝিল, ইহা তাহাদের ব্রাহ্মবিবাহ আইনমতে রেজেস্ট্রি করিবার আবশ্যক দলিল। ছাপা এবং হাতের লেখা আগাগোড়া দুই-তিনবার করিয়া পাঠ করিয়া অবশেষে সে মুখ তুলিল। বেশী সময় যায় নাই, কিন্তু, এইটুকু সময়ের মধ্যেই তাহার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটিল। তাহার এতক্ষণের এতবড় বেদনা অকস্মাৎ কি একপ্রকার কঠিন ঔদাসীন্য ও নিদারুণ বিতৃষ্ণায় রূপান্তরিত হইয়া দেখা দিল। তাহার মনে হইল, জগতের সমস্ত পুরুষ একছাঁচে ঢালা। রাসবিহারী, দয়াল, বিলাস, নরেন্দ্র—আসলে কাহারো সঙ্গে কাহারো প্রভেদ নাই। শুধু বুদ্ধি ও অবস্থার তারতম্যে যা-কিছু প্রভেদ বাহিরে প্রকাশ পায়—এইমাত্র; নহিলে নিজের সুখ ও সুবিধার কাছে নীচতায়, কৃতঘ্নতায়, নির্মম নিষ্ঠুরতায় নারীর পক্ষে ইহারা সকলেই সমান। আজ দয়ালের আচরণটাই তাহাকে সবচেয়ে বেশী বাজিয়াছিল। কারণ, কেমন করিয়া যেন তাহার অসংশয়ে বিশ্বাস জন্মিয়াছিল, তাহার হৃদয়ের একাগ্র কামনার জিনিসটি ইনি জানিতেন। অথচ এই দয়ালের জন্য সে কি না করিয়াছে! সমস্ত হৃদয় দিয়া শ্রদ্ধা করিয়াছে, ভালবাসিয়াছে, একান্ত আপনার ভাবিয়াছে। কিন্তু, নিজের ভাগিনেয়ীর কল্যাণের পার্শ্বে সমস্ত জানিয়া শুনিয়াও, তিনি এই শ্রদ্ধা ও স্নেহের কোন মর্যাদাই রাখিলেন না। তাঁহার চোখের নীচেই যখন দিনের পর দিন এক অনাত্মীয়া রমণীর মর্মান্তিক দুঃখের পথ প্রস্তুত হইতেছিল তখন কতটুকু দ্বিধা, কতটুকু করুণা তাঁহার মনে জাগিয়াছিল! তবে রাসবিহারীর সহিত মূলতঃ তাঁহার পার্থক্য কোন্খানে এবং কতটুকু? আর নরেন্দ্রের কথাটা সে গোড়া হইতেই চিন্তার বাহিরে ঠেলিয়া রাখিয়াছিল, এখনও তাহাকে বিচার করার ভান করিল না। শুধু এই কথাটাই এখন সে আপনাকে আপনি বারংবার বলিতে লাগিল, যদি সকলেই সমান, তবে বিলাসের বিরুদ্ধেই বা তাহার বিদ্বেষ কিসের? বরঞ্চ সে-ই ত সব চেয়ে নির্দোষ! সে-ই ত অপরাধ করিয়াছে সর্বাপেক্ষা কম! বস্তুতঃ, তাহারই ত শুধু বাক্যে এবং ব্যবহারে সামঞ্জস্য দেখা গেল! তাহার যা-কিছু অপরাধ সে ত শুধু তাহারই জন্য। একটু স্থির থাকিয়া বিজয়া আপনাকে আপনি পুনরায় বুঝাইল যে, বিলাসের ভালবাসা সত্য এবং সজীব বলিয়াই সে নীরবে সহিতে পারে নাই, বিরুদ্ধ শক্তিকে সর্বাঙ্গে হাতিয়ার বাঁধিয়া বাধা দিতে রুখিয়া দাঁড়াইয়াছে। ‘যাও’ বলিতেই সস্তা ভদ্রতা বাঁচাইয়া অভিমানভরে চলিয়া যায় নাই! এই যদি অপরাধ তবে শাস্তি দিবার অধিকার আর যাহারই থাক, তাহার নাই। আরও একটা ব্যাপার মনে পড়িল, সে এই কঠিন বাস্তব সংসার। সেদিক দিয়া চিন্তা করিলে এই বিলাসের যোগ্যতাই ত সকলের চেয়ে বড় দেখা যায়। সেই অপদার্থ নরেনের তুলনায় তাহাকে ত কোন মতেই উপেক্ষার পাত্র বলা সাজে না।