বিজয়ার পদনখ হইতে চুল পর্যন্ত শিহরিয়া উঠিল, কিন্তু, সে কোন উত্তর না দিয়া অধোমুখে কাঠের মূর্তির মত বসিয়া রহিল। নরেন সগর্বে ভাতের গ্রাস মুখে তুলিয়া দিয়া খোঁচা দিয়া বলিল, কেমন, দিতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে? বরঞ্চ একবার না হয় বিলাসবাবুর সঙ্গে নিরিবিলি পরামর্শ করবেন! বলিয়া হাঃ হাঃ হাঃ করিয়া হাসিতে লাগিল।
কিন্তু, এইবার বিজয়া মুখ তুলিতেই তাহার প্রবল হাস্য সহসা যেন মার খাইয়া রুদ্ধ হইল। বিজয়ার মুখে যেন রক্তের আভাসমাত্র নাই—এমনি একটি শুষ্ক পাণ্ডুর মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া, নরেন উদ্বিগ্ন শশব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, আপনি পাগল হয়ে গেলেন নাকি? আমি কি সত্যি সত্যিই এই সব দাবী করতে যাচ্চি, না করলেই পাব? বরঞ্চ আমাকেই ত তা হলে ধরে নিয়ে পাগলা গারদে পুরে দেবে।
বিজয়া এ-সকল কথা যেন শুনিতেই পাইল না। কহিল, কৈ দেখি বাবার চিঠি?
নরেন আশ্চর্য হইয়া বলিল, বেশ, আমি কি পকেটে করে নিয়ে বেড়াচ্চি নাকি? আর সে দেখেই বা লাভ কি আপনার?
তা হোক। দরোয়ানের হাতে চিঠি দুটো আজই দেবেন। সে আপনার সঙ্গে কলকাতায় যাবে।
এত তাড়া?
হাঁ।
দত্তা – ২৩-২৪
ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ
নিদ্রাহীন রজনীর পরিপূর্ণ ক্লান্তি লইয়া বিজয়া সকালে নীচের বসিবার ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিল, জমিদা্রী সেরেস্তার খেরো-বাঁধানো খাতাগুলি টেবিলের উপর থাকে থাকে সাজানো রহিয়াছে, এবং বৃদ্ধ গোমস্তা অদূরে দাঁড়াইয়া অপেক্ষা করিতেছে। সে সবিনয়ে কহিল, মা, এগুলো আজ ফিরে চাই-ই।
তাহাকে ঘণ্টা-দুই পরে ঘুরিয়া আসিতে অনুরোধ করিয়া বিজয়া উপরের খাতাটা তুলিয়া লইয়া জানালা-সংলগ্ন কৌচের উপর গিয়া উপবেশন করিল। তাহার মনোযোগ দিবার শক্তিই ছিল না—উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি বারংবার হিসাবের অঙ্ক ছাড়িয়া জানালার বাহিরে এখানে-ওখানে পলায়ন করিতেছিল। হঠাৎ দৃষ্টি পড়িল, বাগানের ধারে একটা গাছতলায় দাঁড়াইয়া বৃদ্ধ রাসবিহারী পরেশকে কি-সকল প্রশ্ন করিতেছেন। আঙুল তুলিয়া কখনও নীচের ঘর, কখনও বা ছাদের উপর নির্দেশ করিতেছেন। দু’জনের কাহারও একটা কথাও না শুনিয়া বিজয়া চক্ষের নিমেষে বৃদ্ধের ক্রূর ইঙ্গিতের মর্ম হৃদয়ঙ্গম করিয়া লইল।
খানিক পরে তিনি ছেলেটাকে ছাড়িয়া দিয়া কাছারি-ঘরের দিকে চলিয়া গেলেন। পরেশ বাড়ির দিকে আসিতেছিল, বিজয়া জানালা দিয়া হাত নাড়িয়া তাহাকে কাছে ডাকিয়া প্রশ্ন করিল, তোকে কি জিজ্ঞেসা করছিলেন রে?
পরেশ কহিল, আচ্ছা মাঠান, সরকারমশায়ের কাছে টাকা নিয়ে আমি ঘুড়ি-নাটাই কিনতে চলে গেনু না? ডাক্তারবাবুর ভাত খাবার বেলা কি আমি বাড়ি ছিনু মাঠান?
বিজয়া কহিল, না।
পরেশ কহিল, তবে বড়বাবু বলে, কি কথা হয়েছিল বল ব্যাটা, নইলে সেপাই দিয়ে তোকে বেঁধে জলবিছুটি দেওয়াব।আমি বন্নু, নতুন দরোয়ান তোমাকে মিথ্যে মিথ্যে নাগিয়েচে। মাঠান বললে পরেশ, ছুট্টে গিয়ে ডাক্তারবাবুকে ডেকে আন, তোকে ভাল নাটাই কিনে দেব—তাই না ছুট্টে গেনু? কিন্তু, বড়বাবুকে বোলো না মাঠান। তোমাকে বলতে তিনি মানা করে দেছে।
জানাইবে না বলিয়া ভরসা দিয়া বিজয়া পরেশকে বিদায় করিল, এবং স্বস্থানে ফিরিয়া আসিয়া পুনরায় খাতা খুলিয়া বসিল; কিন্তু এবার তাহার দৃষ্টির সম্মুখে খাতার লেখা একেবারে লেপিয়া মুছিয়া একাকার হইয়া গেল। শুধু রাত্রি-জাগরণে নয়, অসহ্য ক্রোধে আরক্ত চক্ষু দুটি আগুনের শিখার মত জ্বলিতে লাগিল। অনতিকাল পরেই রাসবিহারী দ্বারের বাহিরে লাঠির শব্দ করিয়া মৃদুমন্দ গতিতে প্রবেশ করিলেন; এবং বিজয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে অল্প একটুখানি কাশিয়া চেয়ার টানিয়া উপবেশন করিলেন।
বিজয়া খাতা হইতে মুখ তুলিয়া কহিল, আসুন। আজ এত সকালে যে?
রাসবিহারী তৎক্ষণাৎ সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়া অত্যন্ত উদ্বেগের সহিত জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমার চোখ দুটি যে ভয়ানক রাঙ্গা দেখাচ্ছে মা? ঠাণ্ডা-টাণ্ডা লাগেনি ত?
বিজয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না।
রাসবিহারী তাহা কানে না তুলিয়া উৎকণ্ঠা প্রকাশ করিতে লাগিলেন। বলিলেন, না বললে ত শুনবো না মা। হয় রাত্রে ভাল ঘুম হয়নি, নয় কোন রকম কিছু—না, আমার কিছুই হয়নি।
কিন্তু, ও-রকম চোখ লাল হবার কারণ ত একটা কিছু—
বিজয়া আর প্রতিবাদ না করিয়া কাজে মন দিল দেখিয়া রাসবিহারী থামিয়া গেলেন। একটু মৌন থাকিয়া কহিলেন, রোদের ভয়েই সকালে আসতে হল মা। দলিল-পত্রগুলো একবার দেখতে হবে—শুনচি নাকি চৌধুরীরা ঘোষপাড়ার সীমানা নিয়ে একটা মামলা রুজু করবে।
জমিদারি-সংক্রান্ত অত্যাবশ্যক দলিলগুলি বনমালী নিজের কাছেই রাখিতেন। একে ত এ সকলের সচরাচর প্রয়োজন হয় না, তাহাতে অন্যত্র খোয়া যাইবার সম্ভাবনা আছে বলিয়া তিনি কোন দিন কাছ-ছাড়া করেন নাই। কলিকাতা হইতে বাড়ি আসিবার সময় বিজয়া এগুলি সঙ্গে আনিয়াছিল, এবং নিজের শোবার ঘরের লোহার আলমারিতে বন্ধ করিয়া রাখিয়াছিল। বিজয়া মুখ তুলিয়া কহিল, তাঁরা মামলা করবেন কে বললে?
রাসবিহারী বিজ্ঞভাবে অল্প হাস্য করিয়া কহিলেন, কেউ বলেনি মা, আমি বাতাসে খবর পাই। তা না হলে কি এতবড় জমিদারিটা এতদিন চালাতে পারতাম?
বিজয়া জিজ্ঞাসা করিল, তাঁরা কতটা দাবী করছেন?
রাসবিহারী মনে মনে হিসাব করিয়া বলিলেন, তা হবে বৈ কি—খুব কম হলেও সেটা বিঘে-দুই হবে।
বিজয়া তাচ্ছিল্যের সহিত কহিল, এই! তা হলে তাঁরাই নিন। এটুকু জায়গা নিয়ে মামলা-মকদ্দমার দরকার নেই।