বিজয়া গম্ভীর হইয়া বলিল, অন্য আদালতের দরকার নেই—বাবার আদেশই আমার আদালত। ও বাড়ি আপনাকে আমি ফিরিয়ে দেব।
তাহার মুখের চেহারা এবং কণ্ঠস্বর ঠিক রহস্যের মত শোনাইল না বটে, কিন্তু সে ছাড়া যে আর কি হইতে পারে তাহাও মনে ঠাঁই দেওয়া যায় না। বিশেষতঃ বিজয়ার পরিহাসের ভঙ্গী এত নিগূঢ় যে, শুধু মুখ দেখিয়া জোর করিয়া কিছু বলা অত্যন্ত কঠিন। তাই নরেন্দ্র নিজেও ছদ্ম-গাম্ভীর্যের সহিত বলিল, তা হলে তাঁর চিঠিটা চোখে না দেখেই বোধ হয় বাড়িটা দিয়ে দেবেন?
বিজয়া কহিল, না, চিঠি আমি দেখতে চাই। কিন্তু, এই কথাই যদি তাতে থাকে তাঁর হুকুম আমি কোন মতেই অমান্য করব না।
নরেন্দ্র কহিল, তাঁর অভিপ্রায় যে শেষ পর্যন্ত এই ছিল তারই বা প্রমাণ কোথায়?
বিজয়া উত্তর দিল, ছিল না তার ত প্রমাণ নেই।
নরেন্দ্র কহিল, কিন্তু, আমি যদি না নিই? দাবী না করি?
বিজয়া কহিল, সে আপনার ইচ্ছা। কিন্তু সে ক্ষেত্রে আপনার পিসীর ছেলেরা আছেন। আমার বিশ্বাস, অনুরোধ করলে তারা দাবী করতে অসম্মত হবেন না।
নরেন্দ্র হাসিয়া কহিল, এ বিশ্বাস আমারও আছে। এমন কি, হলফ করে বলতেও রাজী আছি।
বিজয়া এ হাসিতে যোগ দিল না—চুপ করিয়া রহিল।
নরেন্দ্র পুনরায় কহিল, অর্থাৎ, আমি নিই, না নিই, আপনি দেবেনই?
বিজয়া কহিল, অর্থাৎ বাবার দান করা জিনিস আমি আত্মসাৎ করব না এই আমার প্রতিজ্ঞা।
তাহার সঙ্কল্পের দৃঢ়তা দেখিয়া নরেন মনে মনে বিস্মিত হইল, মুগ্ধ হইল। কিন্তু নিঃশব্দে কিছুক্ষণ থাকিয়া স্নিগ্ধকণ্ঠে বলিল, ও বাড়ি যখন সৎকর্মে দান করেছেন তখন আমি না নিলেও আপনার আত্মসাৎ করার পাপ হবে না। তা ছাড়া, ফিরিয়ে নিয়ে কি করব বলুন? আপনার কেউ নেই যে তারা বাস করবে। আমাকে বাইরের কোথাও না কোথাও কাজ করতেই হবে। তার চেয়ে যে ব্যবস্থা, হয়েছে, সেই ত সবচেয়ে ভাল হয়েছে। আরও এক কথা এই যে বিলাসবাবুকে কোনও মতেই রাজী করাতে পারবেন না।
এই শেষ কথাটায় বিজয়া মনে মনে জ্বলিয়া উঠিয়া কহিল, নিজের জিনিসে অপরকে রাজী করানোর চেষ্টা করার মত অপর্যাপ্ত সময় আমার নেই। কিন্তু, আপনি ত আর এক কাজ করতে পারেন। বাড়ি যখন আপনার দরকার নেই, তখন তার উচিত মূল্য আমার কাছে নিন। তা হলে চাকরিও করতে হবে না, অথচ নিজের কাজও স্বচ্ছন্দে করতে পারবেন। আপনি সম্মত হোন নরেনবাবু।
এই একান্ত মিনতিপূর্ণ অনুনয়ের স্বর অকস্মাৎ শরের মত গিয়া নরেনের হৃদয়ে বিঁধিয়া তাহাকে চঞ্চল করিয়া তুলিল; এবং যদিচ বিজয়ার অবনতমুখে এই মিনতির প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত পড়িয়া লইবার সুযোগ মিলিল না, তথাপি ইহা পরিহাস নয় সত্য, ইহাও বুঝিতে বিলম্ব ঘটিল না। পিতৃঋণের দায়ে তাহাকে গৃহহীন করিয়া এই মেয়েটি যে সুখী নয়, বরঞ্চ হৃদয়ে ব্যথাই অনুভব করিতেছে, এবং কোন একটা উপলক্ষ সৃষ্টি করিয়া তাহার দুঃখের ভার লঘু করিয়া দিতে চায় ইহা নিশ্চয় বুঝিয়া তাহার বুক ভরিয়া উঠিল। কিন্তু, তাই বলিয়া এরূপ প্রস্তাবও ত স্বীকার করা চলে না। যাহা প্রাপ্য নয় গরীব বলিয়া তাহাই বা কিরূপে ভিক্ষা লইবে? আরও একটা কথা আছে। যে সকল সাংসারিক ব্যাপার পূর্বে একেবারেই সমস্যা ছিল, তাহার অনেকগুলিই এখন এই লোকটির কাছে সহজ হইয়া গেছে। সে স্পষ্ট দেখিতে পাইল, বিলাসের সম্বন্ধে বিজয়া আবেগের উপর যাহাই কেন না বলুক, তাহার বাধা ঠেলিয়া শেষ পর্যন্ত এ সঙ্কল্প কিছুতেই কার্যে পরিণত করিতে পারিবে না। ইহাতে শুধু কেবল তাহার লজ্জা এবং বেদনাই বাড়িবে আর কিছু হইবে না।
কিছুক্ষণ তাহার অবনত মুখের প্রতি সস্নেহ দৃষ্টিতে চাহিয়া থাকিয়া পরিহাস-তরলকণ্ঠে বলিল, আপনার মনের কথা আমি বুঝেচি। গরীবকে কোন একটা ছলে কিছু দান করতে চান, এই ত?
ঠিক এই কথাটাই আজ একবার হইয়া গেছে। তাহারই পুনরাবৃত্তিতে বিজয়া বেদনায় ম্লান হইয়া চোখ তুলিয়া কহিল, এ কথায় আমি কত কষ্ট পাই, আপনি জানেন?
নরেন মনে মনে হাসিয়া প্রশ্ন করিল, তবে আসল কথাটা কি শুনি?
বিজয়া কহিল, সত্যি কথাই আমি বরাবর বলেচি; আপনার পাপ মন বলেই শুধু বিশ্বাস করতে পারেন নি। আপনি গরীব হোন, বড়লোক হোন, আমার কি? আমি কেবল বাবার আদেশ পালন করবার জন্যেই আপনাকে ফিরিয়ে দিতে চাচ্চি।
নরেন সহসা গম্ভীর হইয়া বলিল, ওর মধ্যেও একটু মিথ্যে রয়ে গেল—তা থাক। কিন্তু খুব বড় বড় প্রতিজ্ঞা ত করচেন; কিন্তু বাবার হুকুমমত ফিরিয়ে দিতে হলে আরও কত জিনিস দিতে হয় জানেন? শুধু ওই বাড়িটাই নয়।
বিজয়া কহিল, বেশ। নিন, আপনার সম্পত্তি ফিরিয়ে নিন।
এইবার নরেন হাসিয়া ঘাড় নাড়িল। কহিল, খুব বড় গলায় চিৎকার করে ত আমাকে দাবী করতে বলচেন। আমি না করলে আমার পিসীমার ছেলেদের দাবী করতে বলবেন, ভয় দেখাচ্চেন। কিন্তু, তাঁরই আদেশমত দাবী আমার কোথা পর্যন্ত পৌঁছুতে পারে, জানেন কি? শুধু কেবল ওই বাড়িটা আর কয়েক বিঘে জমি নয়, তার ঢের-ঢের বেশী।
বিজয়া উৎসুক হইয়া কহিল, বাবা আর কি আপনাকে দিয়েছেন?
নরেন বলিল, তাঁর সে চিঠিও আমার কাছে আছে। তাতে যৌতুক শুধু তিনি ওইটুকু দিয়েই আমাকে বিদায় করেন নি। যেখানে যা কিছু আছে দেখচেন, সমস্তই তার মধ্যে। আমি দাবী শুধু ওই বাড়িটা করতে পারি তাই নয়। এ বাড়ি, এই ঘর, ওই সমস্ত টেবিল-চেয়ার-আয়না-দেয়ালগিরি-খাট-পালঙ্ক, বাড়ির দাস-দাসী-আমলা-কর্মচারী, মায় তাদের মনিবটিকে পর্যন্ত দাবী করতে পারি, তা জানেন কি? বাবার হুকুম—দেবেন এই সব?