এতক্ষণে ইহার ব্যগ্রতার হেতু বুঝা গেল। সে লাটাইয়ের লোভে এই রৌদ্রের মধ্যে ইঞ্জিনের বেগে ছুটিয়া আসিয়াছে। সুতরাং কোনমতে ছাড়িয়া যাইবে না। তাহার একবার মনে হইল ছেলেটিকে নিজেই একটা লাটাইয়ের দাম দিয়া এইখান হইতে বিদায় করে। কিন্তু আজই এমন করিয়া ডাকিয়া পাঠাইবার কি কারণ, সে কৌতূহলও কিছুতেই নিবারণ করিতে পারিল না। কিন্তু যাওয়া উচিত কি না স্থির করিতে তাহার আরও কিছুক্ষণ লাগিল; এবং শেষ পর্যন্ত স্থিরও কিছু হইল না; তবুও অনিশ্চিত পথ তাহার ওই দিকেই ধীরে ধীরে চলিতে লাগিল।
সমস্ত রাস্তাটা সে ডাকিবার কারণটাই মনে মনে হাতড়াইয়া মরিতে লাগিল, কিন্তু ডাকাটাই যে সব চেয়ে বড় কারণ সেটা আর তাহার চোখে পড়িল না। বাহিরের ঘরে পা দিতেই বিজয়া আসিয়া সুমুখে দাঁড়াইল। দুটি আর্দ্র উৎসুক চক্ষু তাহার মুখের উপর পাতিয়া তীক্ষ্ণকণ্ঠে কহিল, না খেয়ে এত বেলায় চলে যাচ্ছেন যে বড়? আমি মিছামিছি রাগ করি, আমি ভয়ানক মন্দ লোক—আর নিজে?
নরেন গভীর বিস্ময়ভরে বলিল, এর মানে? কে বলেছে আপনি মন্দ লোক, কে বলেছে ও-সব কথা আপনাকে?
বিজয়ার ঠোঁট কাঁপিতে লাগিল; কহিল, আপনি বলেছেন। কেন নলিনীর সামনে আমাকে অমন করে অপমান করলেন? আমাকেই অপমান করলেন, আবার আমাকেই শাস্তি দিতে না খেয়ে চলে যাচ্ছেন? কি করেছি আপনার আমি? বলিতে বলিতেই তাহার দুই চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া আসিল। বোধ করি, তাহাই সামলাইবার জন্য সে তৎক্ষণাৎ ও-দিকের জানালায় গিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইল। নরেন হতবুদ্ধির মত বাক্শূন্য হইয়া চাহিয়া রহিল। এ অভিযোগের কোথায় কি যে জবাব আছে তাহাও যেন খুঁজিয়া পাইল না, ইহার কারণই বা কি তাহাও তেমনি ভাবিয়া পাইল না।
স্নানের জল প্রভৃতি দেওয়া হইয়াছে বেহারা জানাইয়া গেলে বিজয়া ফিরিয়া আসিয়া শান্তভাবে শুধু কহিল, আর দেরি করবেন না, যান।
স্নান সারিয়া নরেন্দ্র আহারে বসিল। বিজয়া একখানা পাখা হাতে করিয়া তাহার অদূরে আসিয়া যখন উপবেশন করিল, তখন অত্যন্ত সংগোপনে তাহার সর্বাঙ্গ আলোড়িত করিয়া যেন লজ্জার ঝড় বহিয়া গেল। বাতাস করিতে উদ্যত দেখিয়া নরেন সঙ্কুচিত হইয়া কহিল, আমাকে হাওয়া করবার দরকার নেই, আপনি পাখাটা রেখে দিন।
বিজয়া মৃদু হাসিয়া কহিল, আপনার দরকার না থাকলেও আমার দরকার আছে। বাবা বলতেন, মেয়েমানুষকে শুধু হাতে কখনও বসতে নেই।
নরেন জিজ্ঞাসা করিল, আপনার খাওয়াও ত হয়নি!
বিজয়া কহিল, না। পুরুষমানুষদের খাওয়া না হলে আমাদের খেতেও নেই।
নরেন খুশী হইয়া বলিল, আচ্ছা, ব্রাহ্ম হলেও ত আপনাদের আচার-ব্যবহার আমাদের মতই।
বিজয়া এ কথা বলিল না যে, অনেক ব্রাহ্মবাড়িতেই তাহা নয়, বরঞ্চ ঠিক উলটো, শুধু তাহার পিতাই কেবল এই-সকল হিন্দু-আচার নিজের বাড়িতে বজায় রাখিয়া গিয়াছিলেন। বরঞ্চ কহিল, এতে আশ্চর্য হবার ত কিছু নেই। আমরা বিলেত থেকেও আসিনি, কাবুল থেকেও আমাদের আচার-ব্যবহার আমদানী করে আনতে হয়নি। এ-রকম না হলেই বরং আশ্চর্য হবার কথা।
চাকর দ্বারের কাছে আসিয়া কহিল, মা, সরকারমশাই হিসেবের খাতা নিয়ে নীচে দাঁড়িয়ে আছেন। এখন কি যেতে বলে দেব?
বিজয়া ঘাড় নাড়িয়া কহিল, হাঁ, আজ আর আমার দেখবার সময় হবে না, তাঁকে কাল একবার আসতে বলে দাও।
ভৃত্য চলিয়া গেলে নরেন বিজয়ার মুখের প্রতি চোখ তুলিয়া কহিল, এইটি আমাকে সবচেয়ে বেশী আনন্দ দেয়।
কোন্টি?
চাকরদের মুখের এই ডাকটি। বলিয়া হাসিয়া কহিল, আপনি ব্রাহ্মমহিলাও বটে, আলোকপ্রাপ্তাও বটে, এবং বিশেষ করে বড়মানুষও বটে। এমনি আলোক-পাওয়া অনেক বাড়িতেই আমাকে আজকাল চিকিৎসা করতে যেতে হয়। তাঁদের চাকর-বাকরেরা মেয়েদের বলে ‘মেম-সাহেব’। সত্যিকারের মেম-সাহেবরা এঁদের যে চক্ষে দেখে, তা জানেন বলেই বোধ করি মাইনে-করা চাকরদের দিয়ে ‘মেম-সাহেব’ বলিয়ে নিয়ে আত্মমর্যাদা বজায় রাখেন। বলিয়া প্রকাণ্ড একটা পরিহাসের মত হাঃ হাঃ হাঃ করিয়া অট্টহাস্যে বাড়িটা পরিপূর্ণ করিয়া দিল। বিজয়া নিজেও হাসিয়া ফেলিল। নরেনের হাসি থামিলে সে পুনরায় কহিল, বাড়ির দাসী-চাকরের মুখের মাতৃ-সম্বোধনের চেয়ে ‘মেম-সাহেব’ ডাকটা যেন বেশী ইজ্জতের! প্রথম দিন আমি বুঝতেই পারিনি বেহারাটা ‘মেম’ বলে কাকে? চাকরটা কি বললে জানেন? বলে, ‘আমি অনেক সাহেব-বাড়িতে চাকরি করেচি, সত্যকারের মেম-সাহেব কি, তা খুব জানি। কিন্তু, কি করব ডাক্তারবাবু? নতুন হিন্দুস্থানী দরোয়ানটা গিন্নীকে ‘মাইজী’ বলে ফেলেছিল বলে মেম-সাহেব তার একটাকা জরিমানা করে দিলেন। চাকরিটা যে বজায় রইল এই তার ভাগ্যি। এমনি রাগ। আচ্ছা, আপনি বোধ হয় এরকম অনেক দেখেছেন, না?
বিজয়া হাসিয়া ঘাড় নাড়িল।
নরেন কহিল, আমাকে এইটে একদিন দেখতে হবে, এই সব মেম-সাহেবদের ছেলে-মেয়েরা মাকে মা বলে, না ‘মেম-সাহেব’ বলে ডাকে! বলিয়া নিজের রসিকতার আনন্দে আর একবার ঘর ফাটাইয়া তুলিবার আয়োজন করিল।
বিজয়া হাসিমুখে কহিল, খেয়ে-দেয়ে সমস্ত দিন ধরে পরচর্চা করে আমোদ করবেন, আমার আপত্তি নেই; কিন্তু আমাকে কি আজ খেতে দেবেন না?
নরেন লজ্জিতভাবে তাড়াতাড়ি দু-চার গ্রাস গিলিয়া লইয়াই সব ভুলিয়া গেল। কহিল, আমিও ত চার-পাঁচ বছর বিলেতে ছিলুম, কিন্তু এই দিশী-সাহেবরা—