কথাটা সত্য, তাই সে আর জিদ করিতে পারিল না; কিন্তু তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া কি ভাবিয়া নলিনী তৎক্ষণাৎ কহিয়া উঠিল, কিন্তু আপনি না হয় এখানেই স্নানাহার করুন নরেনবাবু, আমি গিয়ে মামীমাকে জানাব। শুধু যাবার সময় একবার তাঁকে দেখা দিয়ে যাবেন।
আর আমাকে এমনি অকৃতজ্ঞ নরাধম পেয়েছেন যে, এই রোদের মধ্যে আপনাকে একলা ছেড়ে দেব? বলিয়া নরেন সহাস্যে বিজয়ার মুখের পানে চোখ তুলিয়া কহিল, আপনার কাছে একদিন ত ভালরকম খাওয়া পাওনা আছেই—সেদিন না হয় সকাল সকাল এসে এই খাওয়াটার শোধ তোলবার চেষ্টা করব। আচ্ছা নমস্কার। নলিনীকে কহিল, আর দেরি নয়, চলুন। বলিয়া হাতের টুপিটা মাথায় তুলিয়া দিল।
নলিনী নামিয়া কাছে আসিল, কিন্তু আর একজন যে কাঠের মত দাঁড়াইয়া রহিল, তাহার দুই চক্ষে যে শান-দেওয়া ছুরির আলো ঝলসিতে লাগিল, তাহা দুজনের কেহই লক্ষ্য করিল না; করিলে বোধ করি, নরেন্দ্র দুই-এক পা অগ্রসর হইয়াই সহসা ফিরিয়া দাঁড়াইয়া হাসিয়া বলিতে সাহস করিত না—আচ্ছা, একটা কাজ করলে হয় না? যে জিনিসটা শুরু থেকেই এত দুঃখের মূল, যার জন্যে আমার দেশময় অখ্যাতি, আমাকেই কেন সেটা আজকের আনন্দের দিনে বকশিশ করে দিন না? সেই দুশো টাকাটা কাল-পরশু যেদিন হয় পাঠিয়ে দেব। বলিয়া আরও একবার হাসিবার চেষ্টা করিল বটে, কিন্তু উৎসাহের অভাবে সুবিধা হইল না। বরঞ্চ ও-পক্ষ হইতে প্রত্যুত্তরে একেবারে অপ্রত্যাশিত কড়া জবাব আসিল। বিজয়া কহিল, দাম নিয়ে দেওয়াকে আমি উপহার দেওয়া বলিনে, বিক্রি করা বলি। ও-রকম উপহার দিয়ে আপনি আত্মপ্রসাদ লাভ করতে পারেন; কিন্তু আমাদের শিক্ষা আর এক রকম হয়েছিল। তাই আজ আনন্দের দিনে সেটা বেচতে ইচ্ছে করিনে।
এই আঘাতের কঠোরতায় নরেন্দ্র স্তম্ভিত হইয়া গেল। এমনিই ত সে বিজয়ার মেজাজের প্রায় কোন কূল-কিনারা পায় না—তাহাতে আজ তাহার বুকের মধ্যে তুষের আগুন জ্বলিতেছিল, তাহার দাহ যখন অকস্মাৎ অকারণে বাহির হইয়া পড়িল তখন নরেন তাহাকে চিনিয়া লইতে পারিল না। সে ক্ষণকাল তাহার কঠিন মুখের পানে নিঃশব্দে চাহিয়া থাকিয়া অত্যন্ত ব্যথার সহিত বলিল, আমার একান্ত দীন অবস্থা আমি ভুলেও যাইনি, গোপন করবার চেষ্টাও করিনি যে আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন।
নলিনীকে দেখাইয়া কহিল, আমি এঁকেও আমার সমস্ত ইতিহাস বলেছি। বাবা অনেক দুঃখ-কষ্ট পেয়ে মারা গেছেন। তাঁর মৃত্যুর পরে বাড়ি-ঘরদ্বার যা-কিছু এখানে ছিল সর্বস্ব দেনার দায়ে বিক্রি হয়ে গেছে, কিছুই কারো কাছে লুকোই নি। উপহার দিয়েছি এ কথা বলিনি। আচ্ছা, বলুন ত এসব কি আপনাকে জানাই নি?
নলিনী সলজ্জে সায় দিয়া কহিল, হ্যাঁ।
বিজয়ার মুখ বেদনায়, লজ্জায়, ক্ষোভে বিবর্ণ হইয়া উঠিল—সে শুধু বিহ্বল আচ্ছন্নের মত একদৃষ্টে উভয়ের দিকে নীরবে চাহিয়া রহিল।
তাহার সেই অপরিসীম বেদনাকে বিমথিত করিয়া নরেন্দ্র ম্লানমুখে পুনশ্চ কহিল, আমার কথায় আপনি প্রায়ই অত্যন্ত উত্যক্ত হয়ে উঠেন। হয়ত ভাবেন, নিজের অবস্থাকে ডিঙ্গিয়ে আমি নিজেকে আপনাদের সমান এবং সমকক্ষ বলে প্রচার করতে চাই—হতেও পারে সব কথায় আপনার ওজন ঠিক রাখতে পারিনে, কিন্তু সে আমার অন্যমনস্ক স্বভাবের দোষে। কিন্তু যাক, অসম্ভ্রম যদি করে থাকি আমাকে মাপ করবেন। বলিয়া মুখ ফিরাইয়া চলিতে আরম্ভ করিয়া দিল।
দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
সমস্ত পথটার মধ্যে দুজনের শুধু এই কথাটাই হইল। নলিনী জিজ্ঞাসা করিল, কি উপহার দেবার কথা বলেছিলেন?
নরেন্দ্র ক্লান্তকণ্ঠে কহিল, আর একদিন এ কথা আপনাকে বলব—কিন্তু আজ নয়।
সেই বাঁশের পুলটার কাছে আসিয়া নরেন সহসা দাঁড়াইয়া পড়িয়া কহিল, আজ আমাকে মাপ করতে হবে—আমি ফিরে চললুম। কিন্তু নলিনীকে বিস্ময়ে অভিভূতপ্রায় দেখিয়া পুনরায় বলিল, এইভাবে হঠাৎ ফিরে যাওয়ায় আমার অন্যায় যে কি পর্যন্ত হচ্চে, সে আমি জানি। কিন্তু তবুও ক্ষমা করতে হবে—আজ আমি কোন মতে যেতে পারব না। আপনার মামীমাকে বলে দেবেন আমি আর একদিন এসে—
তাহার সঙ্কল্পের এই আকস্মিক পরিবর্তনে নলিনী যত আশ্চর্য হইয়াছিল, এখন তাহার কণ্ঠস্বর ও মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া ঢের বেশী আশ্চর্য হইল। বোধ হয়, এই জন্যই সে এবিষয়ে আর অধিক অনুরোধ না করিয়া তাহাকে শুধু কহিল, আপনার যে খাওয়া হলো না। কিন্তু আবার কবে আসবেন?
পরশু আসবার চেষ্টা করব, বলিয়া নরেন যে পথে আসিয়াছিল, সেই পথে দ্রুতপদে রেলওয়ে স্টেশনের উদ্দেশে প্রস্থান করিল।
মাঠ পার হইতে আর যখন দেরি নাই, এমন সময় দেখিল কে একটা ছেলে হাত উঁচু করিয়া তাহারই দিকে প্রাণপণে ছুটিয়া আসিতেছে। সে যে তাহার জন্য ছুটিতেছে, এবং হাত তুলিয়া তাহাকেই থামিতে ইঙ্গিত করিতেছে অনুমান করিয়া নরেন্দ্র থমকিয়া দাঁড়াইল। খানিক পরেই পরেশ আসিয়া উপস্থিত হইল এবং হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, মাঠান ডেকে পাঠালেন তোমাকে। চল।
আমাকে?
হিঁ—চল না।
নরেন্দ্র নিশ্চল হইয়া কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া সন্দিগ্ধ-কণ্ঠে কহিল, তুই বুঝতে পারিস নি রে—আমাকে নয়।
পরেশ প্রবলবেগে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হিঁ তোমাকেই। তোমার মাথায় যে সাহেবের টুপি রয়েছে। চল।
নরেন্দ্র আবার কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া প্রশ্ন করিল, তোর মাঠান কি বলে দিলে তোকে?
পরেশ কহিল, মাঠান সেই চিলের ছাত থেকে দৌড়ে নেমে এসে বললে, পরেশ ছুটে যা—এই সোজা গিয়ে বাবুকে ধরে আন। মাথায় সাহেবের টুপি—যা—ছুটে যা—তোকে খুব ভাল একটা লাটাই কিনে দেব। চল না।