ব্যাপারটা একেবারে নূতন। বিজয়া চিঠি লিখিতেছিল, মুখ না তুলিয়াই কহিল, আসতে বল। তাহার মনের ভিতরটা অজ্ঞাত আশঙ্কায় দুলিতে লাগিল; কিন্তু বিলাস প্রবেশ করিতেই সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া শান্তভাবে নমস্কার করিয়া কহিল, আসুন। বিলাস আসন গ্রহণ করিয়া বলিল, কাজের ভিড়ে আসতে পারিনে, তোমার শরীর ভাল আছে?
বিজয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হাঁ।
সেই ওষুধটাই চলছে?
বিজয়া ইহার উত্তর দিল না, কিন্তু বিলাসও প্রশ্নের পুনরুক্তি না করিয়া অন্য কথা কহিল। বলিল, কাল নব-বৎসরের নূতন দিন—আমার ইচ্ছা হয় সকলকে একত্র করে কাল সকালবেলা একটু ভগবানের নাম করা হয়।
সে যে তাহার প্রশ্ন লইয়া পীড়াপীড়ি করিল না, কেবল ইহাতেই বিজয়ার মনের উপর হইতে একটা ভার নামিয়া গেল। সে খুশী হইয়া বলিয়া উঠিল, এ ত খুব ভাল কথা।
বিলাস বলিল, কিন্তু নানা কারণে মন্দিরে যাওয়ার সুবিধে হলো না। যদি তোমার অমত না হয় ত আমি বলি এইখানেই—
বিজয়া তৎক্ষণাৎ সম্মত হইয়া সায় দিল, এমন কি উৎসাহিত হইয়া উঠিল। কহিল, তা হলে ঘরটাকে একটুখানি ফুল-পাতা-লতা দিয়ে সাজালে ভাল হয় না? আপনাদের বাড়িতে ত ফুলের অভাব নেই—যদি মালীকে হুকুম দিয়ে কাল ভোর থাকতেই—কি বলেন? হতে পারে না কি?
বিলাস বিশেষ কোন প্রকার আনন্দের আড়ম্বর না দেখাইয়া সহজভাবে বলিল, বেশ, তাই হবে। আমি সমস্ত বন্দোবস্ত ঠিক করে দেব।
বিজয়া ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া বলিল, কাল ত বৎসরের প্রথম দিন—আচ্ছা, আমি বলি কি অমনি একটু খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করলে কি—
বিলাস এ প্রস্তাবও অনুমোদন করিল এবং উপাসনার পরে জলযোগের আয়োজন যাহাতে ভাল রকম হয়, সে বিষয়ে নায়েবকে হুকুম দিয়া যাইবে জানাইল। আরও দুই-চারিটা সাধারণ কথাবার্তার পরে সে বিদায় গ্রহণ করিলে বহুদিনের পরে বিজয়ার অন্তরের মধ্যে তৃপ্তি ও উল্লাসের দক্ষিণা-বাতাস দিতে লাগিল। সেদিনকার সেই প্রকাশ্য সংঘর্ষের পর হইতে অব্যক্ত গ্লানির আকারে যে বস্তুটি তাহাকে অনুক্ষণ দুঃখ দিতেছিল, তাহার ভার যে কত ছিল, আজ নিষ্কৃতি পাইয়া সে যেমন অনুভব করিল এমন বোধ করি কোনদিন করে নাই। তাই আজ তাহার ব্যথার সহিত মনে হইতে লাগিল, এই কয়েকদিনের মধ্যে বিলাস পূর্বেকার অপেক্ষা যেন অনেকটা রোগা হইয়া গিয়াছে। অপমান ও অনুশোচনার আঘাত ইহার প্রকৃতিকে যে পরিবর্তিত করিয়া দিয়াছে তাহা চোখের উপর সুস্পষ্ট দেখিতে পাইয়া অজ্ঞাতসারে বিজয়ার দীর্ঘশ্বাস পড়িল, এবং বৃদ্ধ রাসবিহারীর সেদিনের কথাগুলি চুপ করিয়া বসিয়া মনে মনে আলোচনা করিতে লাগিল। বিলাসবিহারী তাহাকে যে অত্যন্ত ভালবাসে তাহা ভাষায়, ইঙ্গিতে, ভঙ্গীতে, সর্বপ্রকারেই ব্যক্ত করা হইয়াছে, অথচ একটা দিনের জন্যও সঙ্গোপনে এই ভালবাসার কথা বিজয়ার মনে স্থান পায় না। বরঞ্চ, সন্ধ্যার ঘনীভূত অন্ধকারে একাকী ঘরের মধ্যে সঙ্গ-বিহীন প্রাণটা যখন ব্যথায় ব্যাকুল হইয়া উঠে, তখন কল্পনার নিঃশব্দ-পদসঞ্চারে ধীরে ধীরে যে আসিয়া তাহার পাশে বসে, সে বিলাস নয়, আর একজন। অলস মধ্যাহ্নে বইয়ে যখন মন বসে না, সেলাইয়ের কাজও অসহ্য বোধ হয়, প্রকাণ্ড শূন্য বাড়িটা রবি-করে খাঁ খাঁ করিতে থাকে তখন সুদূর ভবিষ্যতে একদিন এই শূন্য গৃহই পূর্ণ করিয়া যে ঘরকন্নার স্নিগ্ধ ছবিটি তাহার অন্তরে ধীরে ধীরে জাগিয়া উঠিতে থাকে, তাহার মধ্যে কোথাও বিলাসের জন্য এতটুকু স্থান থাকে না।অথচ, যে লোকটি সমস্ত জায়গা জুড়িয়া বসে, সংসার-যাত্রার দুর্গম পথে সহায় বা সহযোগী হিসাবে মূল্য তাহার বিলাসের অপেক্ষা অনেক কম। সে যেমন অপটু, তেমনি নিরুপায়। বিপদের দিনে ইহার কাছে কোন সাহায্যই মিলিবে না। তবুও এই অকেজো মানুষটারই সমস্ত অকাজের বোঝা সে নিজে সারাজীবন মাথায় লইয়া চলিতেছে মনে করিতেও বিজয়ার সমস্ত দেহ-মন অপরিমিত আনন্দবেগে থরথর করিয়া কাঁপিতে থাকে। বিলাস চলিয়া গেলে বিজয়ার এই মনোভাবের আজও যে কোন ব্যতিক্রম ঘটিল তাহা নহে, কিন্তু আজ সে বিনা প্রার্থনায় বিলাসের দোষের পুনর্বিচারের ভার হাতে তুলিয়া লইল, এবং ঘটনাচক্রে তাহার স্বভাবের যে পরিচয় প্রকাশ পাইয়াছে বাস্তবিক স্বভাব যে তাহার এত হীন নহে, কাহারও সহিত কোন তর্ক না করিয়া সে আপনা-আপনি তাহা মানিয়া লইল।
এমন কি, নিরতিশয় উদারতার সহিত ইহাও আজ সে আপনার কাছে গোপন করিল না যে, বিলাসের মত মানসিক অবস্থায় পড়িয়া জগতে অধিকাংশ লোকেই হয়ত ভিন্নরূপ আচরণ দেখাইতে পারিত না। সে যে ভালবাসিয়াছে এবং ভালবাসার অপরাধই তাহাকে লাঞ্ছিত এবং দণ্ডিত করিয়াছে, ইহাই বার বার স্মরণ করিয়া আজ সে করুণামিশ্রিত মমতার সহিত তাহাকে মার্জনা করিল।
সকালে উঠিয়া শুনিল, বিলাস বহুপূর্বেই লোকজন লইয়া ঘর-সাজানোর কাজে লাগিয়া গিয়াছে। তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হইয়া নীচে নামিয়া আসিয়া লজ্জিতভাবে কহিল, আমাকে ডেকে পাঠান নি কেন?
বিলাস স্নিগ্ধস্বরে বলিল, দরকার কি!
বিজয়া একটু হাসিয়া প্রসন্নমুখে জবাব দিল, আমি বুঝি এতই অকর্মণ্য যে এদিকেও কিছু সাহায্য করতে পারিনে? আচ্ছা, এখন বলুন আমি কি করব?
অনেক দিনের পর বিলাস আজ হাসিল, কহিল, তুমি শুধু নজর রেখো, আমাদের কাজে ভুল হচ্ছে কিনা।
আচ্ছা, বলিয়া বিজয়া হাসিমুখে একটা কোচের উপর গিয়া বসিল। খানিক পরেই প্রশ্ন করিল, খাবার বন্দোবস্ত?