বিজয়ার ক্রোধোন্মত্ততা ধীরে ধীরে মিলাইয়া গেলে, সে নিজের অসংযত রূঢ়তা এবং নির্লজ্জ প্রগল্ভতা স্মরণ করিয়া লজ্জায় মরিয়া যাইতেছিল। বাড়ির সমস্ত চাকর-বাকর এবং কর্মচারীদের সম্মুখে উচ্চকণ্ঠে সে এই যে একটা নাটকের অভিনয় করিয়া বসিল, হয়ত বা ইহারই মধ্যে তাহা নানা আকারে পল্লবিত এবং অতিরঞ্জিত হইয়া গ্রামের বাটীতে বাটীতে পুরুষমহলে আলোচিত হইতেছে, এবং পুকুর ও নদীর ঘাটে মেয়েদের হাসি-তামাশার ব্যাপার হইয়া উঠিয়াছে। ইহারই কদর্যতা কল্পনা করিয়া সে সেই অবধি আর ঘরের বাহির পর্যন্ত আসিতে পারে নাই। লজ্জা শতগুণে বাড়িয়া গেছে আরও এই মনে করিয়া যে, আজ যাহাকে সে ভৃত্য বলিয়া প্রকাশ্যে লাঞ্ছনা করিতে সঙ্কোচ মানে নাই, দুই দিন বাদে স্বামী বলিয়া তাহার গলায় বরমাল্য পরাইবার কথা রাষ্ট্র হইতে কোথাও আর বাকী নাই।
তাই রাসবিহারী যখন ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকিয়া নিঃশব্দ প্রসন্ন-মুখে আসন গ্রহণ করিলেন তখন বিজয়া মুখ তুলিয়া তাঁহার পানে চাহিতেও পারিল না। কিন্তু ইহারই জন্য সে প্রত্যেক মুহূর্তেই প্রতীক্ষা করিয়াছিল, এবং যে-সকল যুক্তিতর্কের তরঙ্গ এবং অপ্রিয় আলোচনা আলোড়িত হইয়া উঠিবে, তাহার মোটামুটি খসড়াটা কাল হইতেই ভাবিয়া রাখিয়াছিল বলিয়া সে একপ্রকার স্থির হইয়াই বসিয়া রহিল। কিন্তু, বৃদ্ধ ঠিক উলটা সুর ধরিয়া বিজয়াকে একেবারে অবাক করিয়া দিলেন। তিনি ক্ষণেক কাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, মা বিজয়া, শুনে পর্যন্ত যে আমার কি আনন্দ হয়েছে তা জানাবার জন্যে আমি কালই ছুটে আসতাম—যদি না সেই অম্বলের ব্যথাটা আমাকে বিছানায় পেড়ে ফেলত। দীর্ঘজীবী হও মা, আমি এই ত চাই! এই ত তোমার কাছে আশা করি। বলিয়া অত্যন্ত উচ্চভাবের আর একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করিয়া কহিলেন, সেই সর্বশক্তিমান মঙ্গলময়ের কাছে শুধু এই প্রার্থনা জানাই, সুখে-দুঃখে, ভালতে-মন্দতে, যেন আমাকে তিনি যা ধর্ম, যা ন্যায় তার প্রতিই অবিচলিত শ্রদ্ধা রাখবার সামর্থ্য দেন। এই বলিয়া তিনি যুক্তকর মাথায় ঠেকাইয়া চোখ বুজিয়া, বোধ করি, সেই সর্বশক্তিমানকেই প্রণাম করিলেন।
পরে চোখ চাহিয়া হঠাৎ উত্তেজিতভাবে বলিতে লাগিলেন, কিন্তু এই কথাটা আমি কোনমতেই ভেবে পাইনে বিজয়া, বিলাস আমার মত একটা খোলা ভোলা উদাসীন লোকের ছেলে হয়ে এত বড় পাকা বিষয়ী হয়ে উঠলো কি করে? যার বাপের আজও সংসারে কাজকর্মের জ্ঞান, লাভ-লোকসানের ধারণাই জন্মালো না, সে এই বয়সের মধ্যেই এরূপ দৃঢ়কর্মী হয়ে উঠল কেমন করে? কি যে তাঁর খেলা, কি যে সংসারের রহস্য, কিছুই বোঝবার জো নেই মা। বলিয়া আর একবার মুদ্রিত-নেত্রে তিনি মাথা নত করিলেন।
বিজয়া নীরবে বসিয়া রহিল। রাসবিহারী আবার একটু মৌন থাকিয়া বলিতে লাগিলেন, কিন্তু কোন জিনিসেরই ত অত্যন্ত ভাল নয়! জানি, বিলাসের কাজ-অন্ত প্রাণ। সেখানে সে অন্ধ। কর্তব্য-কর্মে অবহেলা তার বুকে শূলের মত বাজে; কিন্তু তাই বলে কি মানীর মান রাখতে হবে না? দয়ালের মত লোকেরও কি ত্রুটি মার্জনা করা আবশ্যক নয়? জানি, অপরাধ ছোট-বড় ধনী-নির্ধন বিচার করে না। কিন্তু তাই ব’লে কি তাকে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হবে? সব বুঝি। কাজ না করাও দোষ, খবর না দিয়ে কামাই করাও খুব অন্যায়, আপিসে ডিসিপ্লিন ভঙ্গ করাও আপিস মাস্টারের পক্ষে বড় অপরাধ; কিন্তু, দয়ালকেও কি—না মা, আমরা বুড়োমানুষ, আমাদের সে তেজও নেই, জোরও নেই—সাহেবরা বিলাসের কর্তব্যনিষ্ঠার যত সুখ্যাতিই করুক, তাকে যত বড়ই মনে করুক—আমরা কিন্তু কিছুতেই ভাল বলতে পারব না। নিজের ছেলে বলে ত এ মুখ দিয়ে মিথ্যে বার হবে না মা! আমি বলি, কাজ না হয় দুদিন পরেই হত, না হয় দশ টাকা লোকসানই হত; কিন্তু তাই বলে কি মানুষের ভুলভ্রান্তি দুর্বলতা ক্ষমা করতে হবে না?
তোমার জমিদারির ভালমন্দের পরেই যে বিলাসের সমস্ত মন পড়ে থাকে সে তার প্রত্যেক কথাটিতেই বুঝতে পারি। কিন্তু, আমাকে ভুল বুঝো না মা। আমি নিজে সংসার-বিরাগী হলেও বিষয়-সম্পত্তি রক্ষা করা যে গৃহস্থের পরম ধর্ম তা স্বীকার করি। তার উন্নতি করা আরও ঢের বড় ধর্ম; কারণ সে ছাড়া জগতের মঙ্গল করা যায় না। আর বিলাসের হাতে তোমাদের দুজনের জমিদারি যদি দ্বিগুণ, চতুর্গুণ, এমন কি দশ গুণ হয় শুনতে পাই, আমি তাতেও বিন্দুমাত্র আশ্চর্য হব না। আর হচ্চেও তাই দেখতে পাচ্ছি। সব ঠিক, সব সত্যি—কিন্তু, তাই বলে যে বিষয়ের উন্নতিতে কোথাও একটু সামান্য বাধা পৌঁছলেই ধৈর্য হারাতে হবে সেও যে মন্দ। আমি তাই সেই অদ্বিতীয় নিরাকারের শ্রীপাদপদ্মে বার বার ভিক্ষা জানাচ্চি মা, তাঁর উদ্ধত অবিনয়ের জন্যে যে শাস্তি তাকে তুমি দিয়েছ, তার থেকেই সে যেন ভবিষ্যতে সচেতন হয়। কাজ! কাজ! সংসারে শুধু কাজ করতেই কি এসেছি! কাজের পায়ে কি দয়ামায়াও বিসর্জন দিতে হবে! ভালই হয়েছে মা, আজ সে তোমার হাত থেকেই তার সর্বোত্তম শিক্ষা লাভ করবার সুযোগ পেলে!
বিজয়া কোন কথাই কহিল না। রাসবিহারী কিছুক্ষণ যেন নিজের অন্তরের মধ্যেই মগ্ন থাকিয়া পরে মুখ তুলিলেন। একটু হাস্য করিয়া, কোমল-কণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, আমার দুটি সন্তানের একটি প্রচণ্ড কর্মী, আর একটির হৃদয় যেন স্নেহ-মমতা-করুণার নির্ঝর! একজন যেমন কাজে উন্মাদ, আর একটি তেমনি দয়া-মায়ায় পাগল! আমি কাল থেকে শুধু স্তব্ধ হয়ে ভাবচি, ভগবান এই দুটিকে যখন জুড়ি মিলিয়ে তাঁর রথ চালাবেন, তখন দুঃখের সংসারে না জানি কি স্বর্গ-ই নেমে আসবে! আমার আর এক প্রার্থনা মা, এই অলৌকিক বস্তুটি চোখে দেখবার জন্যে তিনি যেন আমাকে একটি দিনের জন্যেও জীবিত রাখেন। বলিয়া এইবার তিনি টেবিলের উপর মাথা ঠেকাইয়া প্রণাম করিলেন। মাথা তুলিয়া কহিলেন, অথচ, আশ্চর্য, ধর্মের প্রতিও ত তার সোজা অনুরাগ নয়! মন্দির-প্রতিষ্ঠা নিয়ে কি প্রাণান্ত পরিশ্রমই না সে করেছে! যে তাকে জানে না, সে মনে করবে বিলাসের ব্রাহ্মধর্ম ছাড়া বুঝি সংসারের আর কোন উদ্দেশ্যই নেই। শুধু এরই জন্যে সে বুঝি বেঁচে আছে—এ ছাড়া আর বুঝি সে কিছু জানে না! কিন্তু কি ভুল দেখ মা, নিজের ছেলের কথায় এমনি অভিভূত হয়ে পড়েছি যে, তোমাকেই বোঝাচ্ছি। যেন আমার চেয়ে তাকে তুমি কম বুঝেছ! যেন আমার চেয়ে তার তুমি কম মঙ্গলাকাঙ্ক্ষিণী! বলিয়া মৃদু মৃদু হাস্য করিয়া কহিলেন, আমার এত আনন্দ ত শুধু সেই জন্যেই মা। আমি যে তোমার হৃদয়ের ভিতরটা আরশির মত স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। তোমার কল্যাণের হাতখানি যে বড় উজ্জ্বল দেখা যাচ্ছে।আর তাও বলি, তুমি ছাড়া এ কাজ করতে পারেই বা কে, করবেই বা কে? তার ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ সকলের যে তুমিই সঙ্গিনী! তোমার হাতেই যে তার সমস্ত শুভ নির্ভর করছে! তার শক্তি, তোমার বুদ্ধি; সে ভার বহন করে চলবে তুমি পথ দেখাবে।তবেই ত দু’জনের জীবন একসঙ্গে সার্থক হবে মা! সেইজন্যেই ত আজ আমার সুখ ধরছে না! আজ যে চোখের উপরে দেখতে পেয়েছি বিলাসের আর ভয় নেই, তার ভবিষ্যতের জন্যে আমাকে একটি মুহূর্তের জন্যেও আর আশঙ্কা করতে হবে না; কিন্তু জিজ্ঞাসা করি—এত চিন্তা, এত জ্ঞান, ভবিষ্যৎ-জীবন সফল করে তোলবার এতবড় বুদ্ধি ঐটুকু মাথার মধ্যে এতদিন কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলে মা? আজ আমি যে একবারে অবাক হয়ে গেছি!