বিজয়া কহিল, যাঁর বাড়িতে বিপদ তিনি কি করে কাজ করতে আসবেন?
বিলাস উদ্ধতভাবে বলিল, অমন সবাই বিপদের দোহাই পাড়ে। কিন্তু সে শুনতে গেলে ত আমার চলে না! আমি দরকারী কাজ সেরে রাখতে হুকুম দিয়েছিলাম, হয়নি কেন সেই কৈফিয়ত চাই। বিপদের খবর জানতে চাইনে।
বিজয়ার ওষ্ঠাধর কাঁপিতে লাগিল। কহিল, সবাই মিথ্যাবাদী নয়—সবাই মিথ্যা বিপদের দোহাই দেয় না; অন্ততঃ মন্দিরের আচার্য দেয় না। সে যাক, কিন্তু, আপনাকে জিজ্ঞাসা করি আমি, যখন জানেন, দরকারী কাজ হওয়া চাই-ই, তখন নিজে কেন সেরে রাখেন নি? আপনি কেন চারদিন কাজ কামাই করলেন? কি বিপদ হয়েছিল আপনার শুনি?
বিলাস বিস্ময়ে হতবুদ্ধিপ্রায় হইয়া কহিল, আমি নিজে খাতা সেরে রাখব! আমি কামাই করলাম কেন!
বিজয়া কহিল, হাঁ তাই। মাসে মাসে দু’শ টাকা মাইনে আপনি নেন। সে টাকা ত আমি শুধু শুধু আপনাকে দিইনে, কাজ করবার জন্যেই দিই।
বিলাস কলের পুতুলের মত কেবল কহিল, আমি চাকর? আমি তোমার আমলা?
অসহ্য ক্রোধে বিজয়ার প্রায় হিতাহিত-জ্ঞান লোপ হইয়াছিল; সে তীব্রতর কণ্ঠে উত্তর দিল, কাজ করবার জন্য যাকে মাইনে দিতে হয় তাকে ও-ছাড়া আর কি বলে? আপনার অসংখ্য উৎপাত আমি নিঃশব্দে সয়ে এসেছি; কিন্তু যত সহ্য করেচি, অন্যায় উপদ্রব ততই বেড়ে গেছে। যান, নীচে যান। প্রভু-ভৃত্যের সম্বন্ধ ছাড়া আজ থেকে আপনার সঙ্গে আর আমার কোন সম্বন্ধ থাকবে না। যে নিয়মে আমার অপর কর্মচারীরা কাজ করে, ঠিক সেই নিয়মে কাজ করতে পারেন করবেন, নইলে আপনাকে আমি জবাব দিলুম, আমার কাছারিতে আর ঢোকবার চেষ্টা করবেন না।
বিলাস লাফাইয়া উঠিয়া দক্ষিণ হস্তের তর্জনী কম্পিত করিতে করিতে চীৎকার করিয়া বলিল, তোমার এত সাহস!
বিজয়া কহিল, দুঃসাহস আমার নয়, আপনার। আমার স্টেটেই চাকরি করবেন, আর আমারই উপর আমারই উপর অত্যাচার করবেন! আমাকে ‘তুমি’ বলবার অধিকার কে আপনাকে দিয়েছে? আমার চাকরকে আমারই বাড়িতে জবাব দেবার, আমার অতিথিকে আমারই চোখের সামনে অপমান করবার এ সকল স্পর্ধা কোথা থেকে আপনার জন্মাল?
বিলাস ক্রোধে উন্মত্তপ্রায় হইয়া চীৎকারে ঘর ফাটাইয়া বলিল, অতিথির বাপের পুণ্য যে, সেদিন তার গায়ে হাত দিইনি—তার একটা হাত ভেঙ্গে দিইনি। নচ্ছার, বদমাইস, জোচ্চোর, লোফার কোথাকার। আর কখনো যদি তার দেখা পাই—
চীৎকার-শব্দে ভীত হইয়া গোপাল কানাই সিংকে ডাকিয়া আনিয়াছিল; দ্বারপ্রান্তে তাহার চেহারা দেখিতে পাইয়া বিজয়া লজ্জিত হইয়া কণ্ঠস্বর সংযত এবং স্বাভাবিক করিয়া কহিল, আপনি জানেন না, কিন্তু আমি জানি সেটা আপনারই কত বড় সৌভাগ্য যে তাঁর গায়ে হাত দেবার অতি-সাহস আপনার হয়নি। তিনি উচ্চশিক্ষিত বড় ডাক্তার। সেদিন তাঁর গায়ে হাত দিলেও হয়ত তিনি একজন পীড়িত স্ত্রীলোকের ঘরের মধ্যে বিবাদ না করে সহ্য করেই চলে যেতেন, কিন্তু এই উপদেশটা আমার ভুলেও অবহেলা করবেন না, ভবিষ্যতে তাঁর গায়ে হাত দেবার শখ যদি আপনার থাকে ত হয় পিছন থেকে দেবেন, না হয় আপনার মত আরও পাঁচ-সাতজনকে সঙ্গে নিয়ে তবে সুমুখ থেকে দেবেন, কিন্তু বিস্তর চেঁচামেচি হয়ে গেছে, আর না। নীচে থেকে চাকর-বাকর দরোয়ান পর্যন্ত ভয় পেয়ে ওপরে উঠে এসেছে। যান, নীচে যান; বলিয়া সে প্রত্যুত্তরের অপেক্ষামাত্র না করিয়া পাশের দরজা দিয়া ও-ঘরে চলিয়া গেল।
দত্তা – ১৯-২০
ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
ছেলের মুখে ব্যাপারটা শুনিয়া ক্রোধে,বিরক্তিতে ও আশাভঙ্গের নিদারুণ হতাশ্বাসে রাসবিহারীর ব্রহ্ম-জ্ঞান ও আনুষঙ্গিক ইত্যাদির খোলস একমুহূর্তে খসিয়া পড়িয়া গেল। তিনি তিক্ত-কটুকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, আরে বাপু, হিঁদুরা যে আমাদের ছোটলোক বলে, সেটা ত আর মিছে কথা নয়। ব্রাহ্মই হই, আর যাই হই—কৈবর্ত ত? বামুন-কায়েতের ছেলে হলে ভদ্রতাও শিখতিস, নিজের ভালমন্দ কিসে হয়, না হয়, সে কাণ্ডজ্ঞানও জন্মাত। যাও, এখন মাঠে মাঠে হাল-গরু নিয়ে কুল-কর্ম কোরে বেড়াও গে। উঠতে বসতে তোকে পাখিপড়া করে শেখালাম যে, ভালয় ভালয় কাজটা একবার হয়ে যাক, তার পরে যা ইচ্ছে হয় করিস; কিন্তু তোর সবুর সইল না, তুই গেলি তাকে ঘাঁটাতে! সে হলো রায়-বংশের মেয়ে! ডাকসাইটে হরি রায়ের নাতনি, যার ভয়ে বাঘে-বলদে একঘাটে জল খেত। তুই হাত বাড়িয়ে গেছিস তার নাকে দড়ি পরাতে—মুখ্যু কোথাকার! মান-ইজ্জত গেল, এতবড় জমিদারির আশা-ভরসা গেল, মাসে মাসে দু-দশ টাকা মাইনে বলে আদায় হচ্ছিল, সে গেল—যা এখন চাষার ছেলে চাষ-বাস করে খেগে যা! আবার আমার কাছে এসেছেন চোখ রাঙ্গিয়ে তার নামে নালিশ করতে? যা যা—সুমুখ থেকে সরে যা হতভাগা বোম্বেটে শয়তান।
ঘটনাটা না ঘটিলেই যে ঢের ভাল হইত, তাহার বিলাস নিজেও বুঝিতেছিল। তাহাতে পিতৃদেবের এই ভীষণ উগ্রমূর্তি দেখিয়া তাহার সতেজ আস্ফালন নিবিয়া জল হইয়া গেল। তথাপি কি একটু কৈফিয়ত দিবার চেষ্টা করিতেই ক্রুদ্ধ পিতা দ্রুতবেগে তাঁহার নিজের ঘরে গিয়া প্রবেশ করিলেন। কিন্তু রাগের মাথায় ছেলেকে যাই বলুন, কাজের বেলায় রাসবিহারী ক্রোধের উত্তেজনাতেও কখনো তাড়াহুড়া করিয়া কাজ মাটি করেন নাই, আলস্য করিয়াও কখনো ইষ্ট নষ্ট করেন নাই। তাই সেদিনটা তিনি ধৈর্য ধরিয়া বিজয়াকে শান্ত হইবার সময় দিয়া পরদিন তাঁহার নিজস্ব শান্তি এবং অবিচলিত গাম্ভীর্য লইয়া বিজয়ার বসিবার ঘরে দেখা দিলেন, এবং চৌকি টানিয়া লইয়া উপবেশন করিলেন।