বিজয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, এখন তিনি কোথায় আছেন?
বনমালী বলিয়াছিলেন, তার মামার কাছে—বর্মায়। জগদীশের এখন ত আর সব কথা গুছিয়ে বলবার ক্ষমতা নেই, তবু তার মুখের দুই-একটা ভাসা ভাসা কথায় মনে হয়, যেন সে ছেলে তার মায়ের সমস্ত সদ্গুণই পেয়েছে। ভগবান করুন, যেখানে যেমন করেই থাক যেন বেঁচে থাকে।
সন্ধ্যা হইয়াছিল। ভৃত্য আলো দিতে আসিয়া, বিলাসবাবুর আগমন-সংবাদ জানাইয়া গেলে, বনমালী বলিয়াছিলেন, তবে তুমি নীচে যাও মা, আমি একটু বিশ্রাম করি।
বিজয়া পিতার শিয়রের বালিশগুলি গুছাইয়া দিয়া, পায়ের উপর শালখানি যথাস্থানে টানিয়া দিয়া, আলোটা চোখের উপর হইতে আড়াল করিয়া দিয়া নীচে নামিয়া গেলে, পিতার জীর্ণ বক্ষ ভেদিয়া শুধু একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়িয়াছিল। সেদিন বিলাসের আগমন-সংবাদে কন্যার মুখের উপর যে আরক্ত আভাটুকু দেখা দিয়াছিল, বৃদ্ধকে তাহা ব্যথাই দিয়াছিল।
বিলাসবিহারী রাসবিহারীর পুত্র। সে এই কলকাতা শহরে থাকিয়া বহুদিন যাবৎ প্রথমে এফ. এ. এবং পরে বি. এ. পড়িতেছে। বনমালী সমাজ ত্যাগ করিয়া অবধি বড় একটা দেশে যাইতেন না। যদিচ ব্যবসায়ের শ্রীবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশেও জমিদারি অনেক বাড়াইয়াছিলেন, কিন্তু সে-সমস্ত তত্ত্বাবধানের ভার বাল্যবন্ধু রাসবিহারীর উপরেই ছিল।
সেই সূত্রেই বিলাসের এ বাটীতে আসা-যাওয়া আরম্ভ হইয়া কিছুদিন হইতে অন্য যে-কারণে পর্যবসিত হইয়াছিল, তাহা পরে প্রকাশ পাইবে।
দত্তা – ০৩-০৪
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
মাস-দুই হইল বনমালীর মৃত্যু হইয়াছে। তাঁহার কলিকাতার এত বড় বাড়িতে বিজয়া এখন একা। তাহার দেশের বিষয়-সম্পত্তির দেখাশুনা রাসবিহারীই করিতে লাগিলেন, এবং সেই সূত্রে তাহার একপ্রকার অভিভাবক হইয়াও বসিলেন। কিন্তু নিজে থাকেন গ্রামে, সেইজন্য পুত্র বিলাসবিহারীর উপরেই বিজয়ার সমস্ত খবরদারির ভার পড়িল। সে-ই তাহার প্রকৃত অভিভাবক হইয়া উঠিল।
তখন এই সময়টায়, প্রতি ব্রাহ্মপরিবারে ‘সত্য’, ‘সুনীতি’, ‘সুরুচি’ এই শব্দগুলা বেশ বড় করিয়াই শিখানো হইত। কারণ বিদেশে পড়িতে আসিয়া হিন্দু যুবকেরা যখন পিতামাতার বিরুদ্ধে, দেবদেবীর বিরুদ্ধে, প্রতিষ্ঠিত সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়া এই সমাজের বাঁধানো খাতায় নাম লিখাইয়া বসিত, তখন এই শব্দগুলাই চাড়া দিয়া তাহাদের কাঁচা মাথা ঘাড়ের উপর সোজা করিয়া রাখিত—ঝুঁকিয়া ভাঙ্গিয়া পড়িতে দিতো না। তাহারা কহিত, যাহা সত্য বলিয়া বুঝিবে, তাহাই করিবে। মায়ের অশ্রুজলই বল, আর বাপের দীর্ঘনিশ্বাসই বল, কিছুই দেখিবার শুনিবার প্রয়োজন নাই। ও-সব দুর্বলতা সর্বপ্রযত্নে পরিহার করিবে, নচেৎ আলোকের সন্ধান পাইবে না। কথাগুলা বিজয়াও শিখিয়াছিল।
আজ গ্রাম হইতে বিলাসবাবু বৃদ্ধ মাতাল জগদীশের মৃত্যু-সংবাদ লইয়া আসিয়াছিলেন। বিজয়ার সে পিতৃবন্ধু বটে, কিন্তু বিলাসবাবু যখনই বলিতে লাগিলেন, কেমন করিয়া জগদীশ মদ খাইয়া মাতাল হইয়া ছাদের উপর হইতে পড়িয়া মরিয়াছে, তখন ব্রাহ্মধর্মের সুনীতি স্মরণ করিয়া বিজয়া এই দুর্ভাগা পিতৃসখার বিরুদ্ধে ঘৃণায় ওষ্ঠ কুঞ্চিত করিতে বিন্দুমাত্র সঙ্কোচ বোধ করিল না। বিলাস বলিতে লাগিল, জগদীশ মুখুয্যে আমার বাবারও ছেলেবেলার বন্ধু ছিলেন; কিন্তু তিনি তার মুখ পর্যন্ত দেখতেন না। টাকা ধার করতে দু’বার এসেছিল, বাবা চাকর দিয়ে তাকে ফটকের বার করে দিয়েছিলেন। তিনি সর্বদা বলেন, এই সব দুর্নীতিপরায়ণ লোকগুলোকে প্রশ্রয় দিলে, মঙ্গলময় ভগবানের শ্রীচরণে অপরাধ করা হয়।
বিজয়া সায় দিয়া কহিল, অতি সত্য কথা।
বিলাস উৎসাহিত হইয়া বক্তৃতার ভঙ্গিতে বলিতে লাগিল, বন্ধুই হোক, আর যেই হোক, দুর্বলতা-বশে কোনমতেই ব্রাহ্মসমাজের চরম আদর্শকে ক্ষুণ্ণ করা উচিত নয়। জগদীশের সমস্ত সম্পত্তি এখন ন্যায়তঃ আমাদের। তার ছেলে পিতৃঋণ শোধ করতে পারে ভাল, না পারে, আইনমত আমাদের এই দণ্ডেই সমস্ত হাতে নেওয়া উচিত। বস্তুতঃ ছেড়ে দেবার আমাদের কোন অধিকার নেই। কারণ এই টাকায় আমরা অনেক সৎকার্য করতে পারি। সমাজের কোন ছেলেকে বিলাত পর্যন্ত পাঠাতে পারি; ধর্ম-প্রচারে ব্যয় করতে পারি; কত কি করতে পারি। কেন তা না করব বলুন?
তা ছাড়া জগদীশবাবু কিংবা তাঁর ছেলে আমাদের সমাজভুক্ত নয় যে, তাকে দয়া করা আবশ্যক। আপনার সম্মতি পেলেই বাবা সমস্ত ঠিক করে ফেলবেন বলে আজ আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন।
বিজয়া মৃত পিতার শেষ কথাগুলা স্মরণ করিয়া ভাবিতে লাগিল—সহসা জবাব দিতে পারিল না। তাহাকে ইতস্ততঃ করিতে দেখিয়া বিলাস সজোরে প্রবলকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, না, না, আপনাকে ইতস্তত করতে আমি কোন মতেই দেব না। দ্বিধা, দুর্বলতা—পাপ! শুধু পাপ নয়, মহাপাপ! আমি মনে মনে সঙ্কল্প করেছি, তার বাড়িটায় আপনার নাম করে—যা কোথাও নেই, কোথাও হয়নি—আমি তাই করব। পাড়াগাঁয়ের মধ্যে ব্রাহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেশের হতভাগ্য মূর্খ লোকগুলোকে ধর্মশিক্ষা দেব। আপনি একবার ভেবে দেখুন দেখি, এদের মূর্খতার জ্বালাতেই বিরক্ত হয়ে আপনার স্বর্গীয় পিতৃদেব দেশ ছেড়েছিলেন কি না। তাঁর কন্যা হয়ে কি আপনার উচিত নয়—এই নোব্ল প্রতিশোধ নিয়ে তাদেরই এই চরম উপকার করা! বলুন, আপনি এ কথার উত্তর দিন।
বিজয়া বিচলিত হইয়া উঠিল। বিলাস দৃপ্তস্বরে বলিতে লাগিল, সমস্ত দেশের মধ্যে একটা কত বড় নাম, কত বড় সাড়া পড়ে যাবে, ভেবে দেখুন দেখি? হিন্দুদের স্বীকার করতেই হবে—সে ভার আমার উপর—যে, ব্রাহ্মসমাজে মানুষ আছে; হৃদয় আছে, স্বার্থত্যাগ আছে; যাঁকে তারা নির্যাতন করে দেশ থেকে বিদায় করে দিয়েছিল, সেই মহাত্মারই মহীয়সী কন্যা তাদেরই মঙ্গলের জন্য এই বিপুল স্বার্থত্যাগ করেছেন। সমস্ত ভারতবর্ষময় একটা কি বিরাট মর্যাল এফেক্ট হবে, বলুন দেখি। বলিয়া বিলাসবিহারী সম্মুখের টেবিলের উপর একটা প্রচণ্ড চাপড় মারিল। শুনিতে শুনিতে বিজয়া মুগ্ধ হইয়া গিয়াছিল। বাস্তবিক, এত-বড় নামের লোভ সংবরণ করা আঠারো বছরের মেয়ের পক্ষে সম্ভব নয়। তথাপি, পিতার কথাগুলি স্মরণ করিয়া সে দ্বিধাভরে জিজ্ঞাসা করিল, তাঁর ছেলের নাম শুনেচি নরেন্দ্র। এখন সে কোথায় আছে, জানেন?