হঠাৎ এক সময়ে নরেনের চোখে পড়িয়া গেল যে সে মিথ্যা বকিয়া মরিতেছে। কহিল, আপনি কিছুই শুনচেন না।
বিজয়া চকিত হইয়া বলিল, শুনচি বৈ কি।
কি শুনলেন, বলুন তো?
বাঃ—একদিনেই বুঝি সবাই শিখতে পারে?
নরেন হতাশভাবে কহিল, না, আপনার কিছু হবে না। আপনার মত অন্যমনস্ক লোক আমি কোন কালে দেখিনি।
বিজয়া লেশমাত্র অপ্রতিভ না হইয়া বলিল, একদিনেই বুঝি হয়? আপনারই নাকি একদিনে হয়েছিল?
নরেন হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিয়া বলিল, আপনার যে একশ বচ্ছরেও হবে না। তা ছাড়া এ সব শেখাবেই বা কে?
বিজয়া মুখ টিপিয়া হাসিয়া কহিল, আপনি। নইলে ঐ ভাঙা যন্ত্রটা কে নেবে?
নরেন্দ্র গম্ভীর হইয়া কহিল, আপনার নিয়েও কাজ নেই, আমি শেখাতেও পারব না।
বিজয়া কহিল, তা হলে ছবি-আঁকা শিখিয়ে দিন। সে ত শিখতে পারব?
নরেন উত্তেজিত হইয়া বলিল, তাও না। যে বিষয়ে মানুষের নাওয়া-খাওয়া জ্ঞান থাকে না, তাতেই যখন মন দিতে পারলেন না, মন দেবেন ছবি আঁকাতে? কিছুতেই না।
তা হলে ছবি-আঁকাও শিখতে পারব না?
না।
বিজয়া ছদ্ম-গাম্ভীর্যের সহিত কহিল, কিছুই শিখতে না পারলে কিন্তু মাথায় সত্যিই শিঙ্ বেরোবে।
তাহার মুখের ভাবে ও কথায় নরেন পুনরায় উচ্চহাস্য করিয়া উঠিল। কহিল, সেই হবে আপনার উচিত শাস্তি।
বিজয়া মুখ ফিরাইয়া হাসি গোপন করিয়া বলিল, তা বৈ কি। আপনার শেখাবার ক্ষমতা নেই তাই কেন বলুন না। কিন্তু চাকরেরা কি করছে, আলো দেয় না কেন? একটু বসুন, আমি আলো দিতে বলে আসি। বলিয়া দ্রুতপদে উঠিয়া, দ্বারের পর্দা সরাইয়া অকস্মাৎ যেন ভূত দেখিয়া থামিয়া গেল। সম্মুখেই বসিবার ঘরের দুটা চৌকি দখল করিয়া পিতা-পুত্র রাসবিহারী ও বিলাসবিহারী বসিয়া আছেন। বিলাসের মুখের উপর কে যেন এক ছোপ কালি মাখাইয়া দিয়াছে। বিজয়া আপনাকে সংবরণ করিয়া লইয়া অগ্রসর হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কখন এলেন কাকাবাবু? আমাকে ডাকেন নি কেন?
রাসবিহারী শুষ্ক হাস্য করিয়া কহিলেন, প্রায় আধ-ঘণ্টা এসেছি মা। তুমি ও-ঘরে কথায়-বার্তায় ব্যস্ত আছ বলে আর ডাকিনি। ওই বুঝি জগদীশের ছেলে? কি চায় ও?
পাশের ঘর পর্যন্ত শব্দ না পৌঁছায়, বিজয়া এমনি মৃদুস্বরে বলিল, একটা মাইক্রস্কোপ্ বিক্রি করে উনি এখান থেকে যেতে চান। তাই দেখাচ্ছিলেন।
বিলাস ঠিক যেন গর্জন করিয়া উঠিল—মাইক্রস্কোপ্! ঠকাবার জায়গা পেলে না ও!
রাসবিহারী মৃদু র্ভৎসনার ভাবে ছেলেকে বলিলেন, ও কথা কেন? তার উদ্দেশ্য ত আমরা জানিনে—ভালও ত হতে পারে!
বিজয়ার মুখের প্রতি চাহিয়া ঈষৎ হাস্যের সহিত ঘাড় নাড়িয়া কহিলেন, যা জানিনে, সে সম্বন্ধে মতামত প্রকাশ করা আমি উচিত মনে করিনে। তার উদ্দেশ্য মন্দ নাও ত হতে পারে—কি বল মা? বলিয়া একটু থামিয়া নিজেই পুনরায় কহিলেন, অবশ্য জোর করে কিছুই বলা যায় না, সেও ঠিক। তা সে যাই হোক গে, ওতে আমাদের আবশ্যক কি? দূরবীন হলেও না হয় কখনো কালে-ভদ্রে দূরে-টুরে দেখতে কাজে লাগতেও পারে!—ও কে কালীপদ? ও ঘরে আলো দিতে যাচ্ছিস? অমনি বাবুটিকে বলে দিস আমরা কিনতে পারব না—তিনি যেতে পারেন।
বিজয়া ভয়ে ভয়ে বলিল, তাঁকে বলেছি আমি নেব।
রাসবিহারী কিছু আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, নেবে? কেন? তাতে প্রয়োজন কি?
বিজয়া মৌন হইয়া রহিল।
রাসবিহারী জিজ্ঞাসা করিলেন, উনি কত দাম চান?
দু’ শ টাকা।
রাসবিহারী দুই ভ্রূ প্রসারিত করিয়া কহিলেন, দু’শ? দু’শ টাকা চায়? বিলাস তা হলে নেহাত—কি বল বিলাস, কলেজে তোমার এফ. এ. ক্লাসে কেমিস্ট্রীতে ত এসব অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করেচ—দু’শ টাকা একটা মাইক্রস্কোপের দাম? কালীপদ, যা—ওঁকে যেতে বলে দে—এসব ফন্দি এখানে খাটবে না।
কিন্তু যাহাকে বলিতে হইবে, সে যে নিজের কানেই সমস্ত শুনিতেছে, তাহাতে লেশমাত্র সন্দেহ নাই। কালীপদ যাইবার উপক্রম করিতেছে দেখিয়া বিজয়া তাহাকে শান্ত অথচ দৃঢ়-কণ্ঠে বলিয়া দিল, তুমি শুধু আলো দিয়ে এসো গে, যা বলবার আমি নিজেই বলব।
বিলাস শ্লেষ করিয়া তাহার পিতাকে কহিল, কেন বাবা, তুমি মিথ্যে অপমান হতে গেলে? ওঁর হয়ত এখনো কিছু দেখিয়ে নিতে বাকী আছে।
রাসবিহারী কথা কহিলেন না, কিন্তু ক্রোধে বিজয়ার মুখ রাঙ্গা হইয়া উঠিল। বিলাস তাহা লক্ষ্য করিয়াও বলিয়া ফেলিল, আমরাও অনেক রকম মাইক্রস্কোপ্ দেখেচি বাবা, কিন্তু হো হো করে হাসবার বিষয় কখনো কোনটার মধ্যে পাইনি।
কাল খাওয়ানোর কথাও সে জানিতে পারিয়াছিল, আজ উচ্চহাস্যও সে স্বকর্ণে শুনিয়াছিল। বিজয়ার আজিকার বেশভূষার পারিপাট্যও তাহার দৃষ্টি এড়ায় নাই। ঈর্ষার বিষে সে এমনি জ্বলিয়া মরিতেছিল যে, তাহার আর দিগ্বিদিক্ জ্ঞান ছিল না। বিজয়া তাহার দিকে সম্পূর্ণ পিছন ফিরিয়া রাসবিহারীকে কহিল, আমার সঙ্গে কি আপনার কোন বিশেষ কথা আছে কাকাবাবু?
রাসবিহারী অলক্ষ্যে পুত্রের প্রতি একটা ক্রুদ্ধ কটাক্ষ হানিয়া স্নিগ্ধকণ্ঠে বিজয়াকে কহিলেন, কথা আছে বৈ কি মা! কিন্তু তার জন্যে তাড়াতাড়ি কি?
একটু থামিয়া কহিলেন, আর—ভেবে দেখলাম, ওকে কথা যখন দিয়েচ, তখন যাই হোক সেটা নিতে হবে বৈ কি। দু’শ টাকা বেশী, না, কথাটার দাম বেশী! তা না হয়, ওকে কাল একবার এসে টাকাটা নিয়ে যেতে বলে দিক না মা?
বিজয়া এ প্রশ্নের জবাব না দিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনার সঙ্গে কি কাল কথা হতে পারে না কাকাবাবু?