বিজয়া জানালার বাহিরে চাহিয়াছিল; সেই দিকে দৃষ্টি রাখিয়া কহিল, ভদ্রতা বলে একটা জিনিস আছে সে কি আপনি আর কোথাও দেখেন নি?
ভদ্রতা! তাই হবে বোধ হয়। বলিয়া হঠাৎ তাহার একটা নিশ্বাস পড়িল। তার পরে হাত তুলিয়া আবার একবার নমস্কার করিয়া কহিল, যেমন কোরে হোক বাবার ঋণটা যে সমস্ত শোধ হয়েছে, এই আমার ভারী তৃপ্তি। আপনার মন্দিরের দিন দিন শ্রীবৃদ্ধি হোক—আজকের দিনটা আমার চিরকাল মনে থাকবে। আমি চললুম। বলিয়া সে যখন ঘরের বাহিরে আসিয়া পড়িল, তখন ভিতর হইতে অস্ফুট আহ্বান আসিল, একটু দাঁড়ান—
নরেন্দ্র ফিরিয়া দাঁড়াইতে, বিজয়া মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, আপনার মাইক্রস্কোপ্টার দাম কত?
নরেন্দ্র কহিল, কিনতে আমার পাঁচশ’ টাকার বেশী লেগেছিল, এখন আড়াই ‘শ টাকা—দু’শ টাকা পেলেও আমি দিই। কেউ নিতে পারে আপনি জানেন? একেবারে নূতন আছে বললেও হয়।
তাহার বিক্রি করিবার আগ্রহ দেখিয়া মনে মনে অত্যন্ত ব্যথিত হইয়া বিজয়া জিজ্ঞাসা করিল, এত কমে দেবেন, আপনার কি তার সব কাজ শেষ হয়ে গেছে?
নরেন্দ্র নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, কাজ? কিছুই হয়নি।
এই নিশ্বাসটুকুও বিজয়ার লক্ষ্য এড়াইল না। সে ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, আমার নিজেরই একটা অনেকদিন থেকে কেনবার সাধ আছে, কিন্তু হয়ে ওঠেনি। কাল একবার দেখাতে পারেন?
পারি। আমি সমস্ত আপনাকে দেখিয়ে দিয়ে যাব।
একটু চিন্তা করিয়া পুনরায় কহিল, যাচাই করবার সময় নেই বটে, কিন্তু আমি নিশ্চয় বলছি, নিলে আপনি ঠকবেন না।
আবার একটু মৌন থাকিয়া বলিল, টাকার বদলে দাম হয় না, এ এমনি জিনিস। আমার আর কোন উপায় যে নেই, নইলে—আচ্ছা, দুপুরবেলায় আমি নিয়ে আসব।
সে চলিয়া গেলে যতক্ষণ দেখা গেল, বিজয়া অপলক চক্ষে চাহিয়া রহিল; তার পরে ফিরিয়া আসিয়া সুমুখের চৌকিটার উপর বসিয়া পড়িল। কখনো বা তাহার মনে হইতে লাগিল, যতদূর দৃষ্টি যায়, সব যেন খালি হইয়া গেছে—কিছুতেই যেন কোন দিন তাহার প্রয়োজন ছিল না, কিছুই যেন তাহার মরণকাল পর্যন্ত কোন কাজেই লাগিবে না। অথচ সেজন্য ক্ষোভ বা দুঃখ কিছুই মনের মধ্যে নাই। এমনি শূন্যদৃষ্টিতে বাহিরের গাছপালার পানে চাহিয়া মূর্তির মত স্তব্ধভাবে বসিয়া কি করিয়া যে সময় কাটিতেছিল তাহার খেয়াল ছিল না। কখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গেছে, কখন চাকরে আলো দিয়া গেছে সে টেরও পায় নাই। তাহার চৈতন্য ফিরিয়া আসিল তাহার নিজের চোখের জলে। তাড়াতাড়ি মুছিয়া ফেলিয়া হাত দিয়া দেখিল, কখন ফোঁটা ফোঁটা করিয়া অজ্ঞাতসারে পড়িয়া বুকের কাপড় পর্যন্ত ভিজিয়া গেছে। ছি ছি—চাকর-বাকর আসিয়াছে, গেছে—হয়ত তাহারা লক্ষ্য করিয়াছে—হয়ত তাহারা কি মনে করিয়াছে—লজ্জায় আজ সে প্রয়োজনেও কাহাকেও কাছে ডাকিতে পারিল না। রাত্রিতে বিছানায় শুইয়া জানালা খুলিয়া দিয়া তেমনি বাহিরের অন্ধকারে চাহিয়া রহিল; অমনি বস্তু-বর্ণহীন শূন্য অন্ধকারের মত নিজের সমস্ত ভবিষ্যৎটা তাহার চোখে ভাসিতে লাগিল। তাহার পরে কখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল তাহার মনে নাই, কিন্তু ঘুম যখন ভাঙিল তখন প্রভাতের স্নিগ্ধ আলোকে ঘর ভরিয়া গেছে—প্রথমেই মনে পড়িল তাহাকে, যাহার সহিত সে জীবনে পাঁচ-ছয় দিনের বেশি কথা পর্যন্ত বলে নাই। আর মনে পড়িল, যে অজ্ঞাত বেদনা তাহার ঘুমের মধ্যেও সঞ্চরণ করিয়া ফিরিতেছিল তাহারই সহিত কেমন করিয়া যেন সেই লোকটির ঘনিষ্ঠ সংযোগ আছে।
বেলা বাড়িতে লাগিল। কিন্তু যখনই মনে পড়ে সমস্ত কাজকর্মের মধ্যে কোথায় তাহার একটি চোখ এবং একটি কান সারাদিন পড়িয়া আছে, তখন নিজের কাছেই তাহার ভারী লজ্জা বোধ হয়। কিন্তু এ যে কিছুই নয়, এ যে শুধু সেই যন্ত্রটা দেখিবার কৌতূহল, একবার সেটা দেখা হইয়া গেলেই সমস্ত আগ্রহের নিবৃত্তি হইবে, আজ না হয় ত কাল হইবে—এমন করিয়াও আপনাকে আপনি অনেকবার বুঝাইল, কিন্তু কোন কাজেই লাগিল না; বরঞ্চ, বেলার সঙ্গে সঙ্গে উৎকণ্ঠা যেন রহিয়া রহিয়া আশঙ্কায় আত্মপ্রকাশ করিতে লাগিল। পৌষের মধ্যাহ্নসূর্য ক্রমশঃ এক পাশে হেলিয়া পড়িল; আলোকের চেহারায় দিনান্তের সূচনা দেখিয়া বিজয়ার বুক দমিয়া গেল। কাল যে লোক চিরদিনের মত দেশ ছাড়িয়া চলিয়া যাইতেছে, আজ সে যদি এতদূরে আসিতে এতখানি সময় নষ্ট করিতে না পারে তাহাতে আশ্চর্য হইবার কি আছে! তাহার শেষ সম্বলটুকু যদি অপর কাহাকেও বেশি দামে বিক্রয় করিয়া চলিয়া গিয়া থাকে, তাহাকেই বা কি দোষ দিবে কে? তাহাদের শেষ কথাবার্তাগুলি সে বার বার তোলাপাড়া করিয়া নিরতিশয় অনুশোচনার সহিত মনে করিতে লাগিল যে মনের মধ্যে তাহার যাহাই থাক, মুখে সে এ সম্বন্ধে আগ্রহাতিশয্য একেবারেই প্রকাশ করে নাই।
ইহাকে অনিচ্ছা কল্পনা করিয়া সে যদি শেষ পর্যন্ত পিছাইয়া গিয়া থাকে ত দর্পিতার উচিত শাস্তিই হইয়াছে বলিয়া হৃদয়ের ভিতর হইতে যে কঠিন তিরস্কার বারংবার ধ্বনিত হইয়া উঠিতে লাগিল, তাহার জবাব সে কোনদিকে চাহিয়াই খুঁজিয়া পাইল না। কিন্তু পরেশকে কিংবা আর কাহাকেও কোন ছলে তাঁহার কাছে পাঠান যায় কিনা, পাঠাইলেও তাহারা খুঁজিয়া পাইবে কিনা, তিনি আসিতে স্বীকার করিবেন কিনা, এমনি তর্ক-বিতর্ক করিয়া ছটফট করিয়া ঘড়ির পানে চাহিয়া ঘর-বাহির করিয়া যখন কোনমতেই তাহার সময় কাটিতেছিল না, এমনি সময়ে পরেশ ঘরে ঢুকিয়া সংবাদ দিল, মাঠান, নীচে এসো, বাবু এসেছে।