সাবিত্রীকে তিনি আজকাল কখনো ‘তুমি’ কখনো ‘তুই’ যা মুখে আসিত, তাই বলিয়াই ডাকিতেন। সাবিত্রী তাঁহার সেই শেষ ইচ্ছা এবং শেষ চিকিৎসার জন্য কিছুদিন হইল কলিকাতার জোড়াসাঁকোয় একটা বাড়ি ভাড়া লইয়া সিয়াছিল। আজ সন্ধ্যার পর এক পসলা ঝড়বৃষ্টি হইয়া গেলেও আকাশে মেঘ কাটে নাই। উপেন্দ্র অনেকক্ষণ পরে ক্লান্ত চোখ-দুটি মেলিয়া আস্তে আস্তে কহিলেন, সুমুখের জানালাটা একটু খুলে দে দিদি, সেই বড় নক্ষত্রটি একবার দেখি।
সাবিত্রী তাঁহার কপালের রুক্ষ চুলগুলি ধীরে ধীরে সরাইয়া দিতে দিতে মৃদুকণ্ঠে কহিল, গায়ে জোলো-হাওয়া লাগবে যে দাদা!
লাগুক না বোন! আর আমার তাতে ভয় কি?
ভয় তাঁহার শুধু আজ কেন, যেদিন হইতে সুরবালা গিয়াছে সেদিন হইতেই নাই। কিন্তু তাই বলিয়া সাবিত্রীর ত ভয় ঘুচে নাই। তাহার বুঝি যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণই আশ; তাই মৃত্যু যখন শিয়রের পাশে তাহার সঙ্গে সমান আসন দখল করিয়া বসিয়া গেছে, তখনও সে তুচ্ছ জোলো-হাওয়াটাকে পর্যন্ত ঘরে ঢুকিতে দিতে সাহস পায় না। অনিচ্ছুককণ্ঠে কহিল, কিন্তু নক্ষত্র ত দেখা যায় না দাদা, আকাশে যে মেঘ করে আছে।
উপেন্দ্র ম্লান চক্ষু-দুটি উৎসাহে বিস্ফারিত করিয়া বলিলেন, মেঘ? আহা, অসময়ে মেঘ দিদি, খুলে দে, খুলে দে—একবার দেখে নিই, আর ত দেখতে পাব না।
বাহিরে আর্দ্র বায়ু জোরে বহিতেছিল; সাবিত্রী কপালে বুকে হাত দিয়া দেখিল জ্বর বাড়িতেছে; মিনতি করিয়া বলিল, ভাল হও, মেঘ কত দেখবে দাদা,—বাইরে ঝড় বইচে, আজ আমি জানালা খুলতে পারব না।
তাহার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া উপেন্দ্র রাগ করিয়া বলিলেন, ভাল চাস তো খুলে দে সাবিত্রী, নইলে বর্ষার দিনে যখন মেঘ উঠবে, তখন কেঁদে কেঁদে মরবি তা বলে দিয়ে যাচ্চি। আমি আর দেখবার সময় পাব না।
সাবিত্রী আর প্রতিবাদ না করিয়া একফোঁটা চোখের জল মুছিয়া উঠিয়া গিয়া জানালা খুলিয়া দিল।
সেই খোলা জানালার বাহিরে উপেন্দ্র নির্নিমেষ-চক্ষে চাহিয়া রহিলেন। আকাশের কোন্ এক অদৃশ্য প্রান্ত হইতে ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ স্ফুরিত হইতেছিল, তাহারি আলোকচ্ছটায় সম্মুখের গাঢ় মেঘ উদ্ভাসিত হইয়া উঠিতেছে, চাহিয়া চাহিয়া উপেন্দ্রর কিছুতেই যেন আর সাধ মিটে না এমনি মনে হইতে লাগিল।
সাবিত্রী নিজেও একটা গরাদে ধরিয়া সেইদিকে চাহিয়াই চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল, উপেন্দ্রর দৃষ্টি হঠাৎ তাহার উপরে পড়িতে মনে মনে একটু হাসিয়া বলিলেন, আচ্ছা দে দে, জানালা বন্ধ করে দিয়ে কাছে এসে বস। কিন্তু এত মায়া ত ভাল নয় দিদি। একটুখানি গায়ে হাওয়া লাগতে দিতে চাও না, কিন্তু আমি চলে গেলে কি করবে বল ত!
সাবিত্রী জানালা বন্ধ করিয়া দিয়া কাছে ফিরিয়া আসিয়া কহিল, তুমি ত আমাকে কাজ দিয়ে যাবে বলেছ। আমি তাই সারাজীবন ধরে করব। তুমি আমার চোখের ওপরেই দিনরাত থাকবে!
পারবে করতে?
সাবিত্রী আস্তে আস্তে বলিল, কেন পারব না দাদা? তোমার কথায় উনি ত কখনো না বলবেন না।
উপেন্দ্র হাসিমুখে কহিল, উনি কে? সতীশ ত?
সাবিত্রী ঘাড় হেঁট করিয়া চুপ করিয়া রহিল।
উপেন্দ্র তাহার সলজ্জ মৌন মুখের পানে চাহিয়া নিশ্বাস ফেলিলেন। বলিলেন, সাবিত্রী, সতীশ যে আমার কি, সে পরের পক্ষে বোঝা শক্ত। বাইরে থেকে যেটা দেখা যায়, তাতে সে আমার সঙ্গী, আমার আজন্ম সুহৃৎ। কিন্তু যে সম্বন্ধটা দেখা যায় না, সেখানে সতীশ আমার ছোটভাই, আমার শিষ্য, আমার চিরদিনের অনুগত সেবক। সেই রাত্রে তুই যদি দিদি, আত্মপ্রকাশ করে আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতিস, আমার শেষজীবনটা হয়ত এত দুঃখে কাটত না। দিবাকরও হয়ত আমাকে এত ব্যথা দেবার সুযোগ পেত না।
সাবিত্রী সজল-চক্ষে কহিল, আমি ফেরাতে তোমাদের চেয়েছিলুম দাদা, কিন্তু উনি কিছুতেই যেতে দিলেন না, দুই চৌকাঠে হাত দিয়ে আমার পথ আটকে রাখলেন। বললেন, আমি তোমাদের সামনে গেলে তোমাদের অপমান করা হবে।
তাঁরই ইচ্ছে, বলিয়া উপেন্দ্র উপর দিকে চাহিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া নীরব হইলেন।
বাড়িতে উপেন্দ্রর পিতা শিবপ্রসাদ বাতে শয্যাগত, তাঁহাকে এবং সংসার ফেলিয়া মহেশ্বরী সঙ্গে আসিতে পারেন নাই, কিন্তু মেজভাই অভিভাবক হইয়া কলিকাতার বাসায় ছিলেন, তাঁহার এবং আর একজনের পদশব্দ সিঁড়িতে শোনা গেল।
পরক্ষণেই তিনি কবিরাজ সঙ্গে করিয়া ঘরে প্রবেশ করিলেন। কবিরাজ উপেন্দ্রর নাড়ী দেখিয়া জ্বর পরীক্ষা করিয়া ঔষধ পরিবর্তন করিবার প্রস্তাব করিতেই উপেন্দ্র হাতজোড় করিয়া কহিল, ঐটে আমাকে মাপ করতে হবে কবিরাজমশাই। আপনার অগোচর ত কিছু নেই—তবে, যাবার সময়ে আর কেন দুঃখ দেবেন।
প্রাচীন চিকিৎসকের চক্ষু সজল হইয়া উঠিল, বলিলেন, আমরা চিকিৎসক, আমাদের শেষ-মুহূর্তটি পর্যন্ত যে নিরাশ হতে নেই বাবা। তা ছাড়া ভগবান সমস্ত আশা শেষ করে দিলেও ত যাতনা নিবারণ করবার জন্যে ঔষধ দেওয়া চাই।
উপেন্দ্র আর প্রতিবাদ না করিয়া মৌন হইয়া রহিল।
তখন ঔষধ পরিবর্তন করিয়া, ব্যবস্থা নির্দেশ করিয়া বিচক্ষণ চিকিৎসক প্রস্থান করিলেন। তাঁহার ভরসা ত বিন্দুমাত্রও ছিল না, অধিকন্তু আজ সুস্পষ্ট অনুভব করিয়া গেলেন যে, রোগীর, মৃত্যুক্ষণ অত্যন্ত দ্রুতগতিতেই অগ্রসর হইয়া আসিতেছে।
তিনদিন পরে সোমবারের সকালবেলা সাবিত্রী একখানি টেলিগ্রাফ হাতে করিয়া ঘরে ঢুকিয়া কহিল, কাল সকালে তাঁরা জাহাজে উঠেছেন।
কারও নাম দেয়নি সতীশ? কৈ দেখি?