সতীশের মনের মধ্যে এতক্ষণের সেই বিস্মৃত প্রশ্নটা যেন বিদ্যুতের রেখায় খেলিয়া গেল। সে সহসা বলিয়া উঠিল, উপীনদা, আমাদের পশু-বৌঠান কেমন আছেন? তাঁর যে অসুখ শুনে এসেছিলাম।
উপেন্দ্র একমুহূর্তের জন্য দাঁত দিয়া জোর করিয়া অধর চাপিয়া ধরিলেন, তার পরে অভ্যাসমত একবার উপরের দিকে চাহিয়া বলিলেন, পশু নেই—মারা গেছে।
সরোজিনী চেঁচাইয়া উঠিল, সুরবালা-বৌদি নেই?
উপেন্দ্র ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, না।
সতীশ মোটা বালিশটায় হেলান দিয়া মূর্ছাহতের মত শূন্যদৃষ্টিতে চাহিয়া বসিয়া রহিল।
সুরবালা নাই, সে মারা গেছে! এই বার্তা উপেন্দ্রর মুখ দিয়া অতি সহজেই বাহির হইয়া আসিল; কিন্তু এ ‘নাই’ যে কি না-থাকা, এ যাওয়া যে কি যাওয়া, সতীশের চেয়ে কে বেশী জানে! সরোজিনীর চেয়ে কে বেশী দেখিয়াছে! সাবিত্রীর চেয়ে কে বেশী শুনিয়াছে!
তথাপি সুরবালা নাই—সে মরিয়াছে। সতীশের মুখের প্রতি চাহিয়া উপেন্দ্র একটুখানি হাসিয়া কহিলেন, ভগবান নিলেন, তার আর নালিশ কি! কিন্তু এ সময়ে দিবা-ছোঁড়াটা যদি কাছে থাকত! মা-বাপ নেই, ছেলেবেলা থেকে মানুষ করে এত বড় করলাম, সেও কোথায় গেল! কি জানি মরবার আগে একবার তাকে দেখতে পাব কি না।
সতীশ তেমনি মূর্ছাহতের মত থাকিয়াই জিজ্ঞাসা করিল, দিবার কি হলো উপীনদা?
উপেন্দ্র কহিলেন, কি জানি তার কি হলো! কলকাতায় হারানদার বাড়িতে থেকে পড়তে দিলাম—এ লজ্জার কথা কারুকে বলাও যায় না, বলতে ইচ্ছেও করে না—বাড়িতে আজও জানে, সে কলকাতায় পড়চে, সুরো তাকে ভারী ভালবাসতো, সে বেচারা মরবার আগে দেখতে চেয়েছিল, কিন্তু এ সাধ তার পূর্ণ করতে পারলাম না। হারানবাবুর স্ত্রীর সঙ্গে কোথায় যে চলে গেল তার উদ্দেশও নেই।
তিনজন শ্রোতাই একসঙ্গে অব্যক্ত-কণ্ঠে কি একটা চীৎকার করিয়া উঠিল, কিন্তু কোন কথাই স্পষ্ট হইল না।
তার পরে সমস্ত নীরব। সমস্ত ঘরটা যেন একটা শূন্য শ্মশানের মত থমথম করিতে লাগিল।
কেহই উপেন্দ্রর মুখের পানে চাহিতেও পারিল না, কিন্তু প্রত্যেকেরই মনে হইতে লাগিল, তাহাদের এতদিনের দুঃখ-কষ্ট-মান-অভিমানগুলা যেন এই অভ্রভেদী বেদনার কাছে একেবারে তুচ্ছ হইয়া গেছে।
সাবিত্রী সতীশের কাছে সকল কথাই শুনিয়াছিল। সকল কথাই জানিত। সে ভাবিতে লাগিল, এই বিপুল শূন্যতা এই লোকটা কি দিয়া ভরিয়াছে! এ ব্যথা, সে কেমন করিয়া তাহার দৈনন্দিন জীবন-যাত্রার মধ্যে এত সহজে বহিয়া বেড়াইতেছে! বুকের ভিতরে যাহার এতবড় হাহাকার, বাহিরে তাহার এতটুকু আক্ষেপ নাই কেন? এ কি পাইয়াছে? কে ইহার সুখ-দুঃখ এমন সহজ সুসহ করিয়া দিয়াছে!
সে পায়ের উপর আস্তে আস্তে হাত বুলাইতে বুলাইতে কহিল, দাদা, এ-সব ব্যারামে তোমার পক্ষে পাহাড়ের হাওয়া খুব ভাল, না?
উপেন্দ্র তাহার মাথায় হাত দিয়া কহিলেন, হাঁ ভাই, তাই ত ডাক্তারেরা বলেন, কিন্তু ভগবান যাকে তলব করেন, তার কিছুই কাজে লাগে না।
সাবিত্রী বলিল, তা হোক দাদা, আমরা কিন্তু পাহাড়ে গিয়েই থাকব।
উপেন্দ্র হাসিয়া বলিলেন, আচ্ছা, তাই হবে।
মহামায়ার পূজা আসন্ন হইয়া আসিল এবং সতীশ সম্পূর্ণ সুস্থ হইবার পূর্বেই বাঙালীর সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দোজ্জ্বল দিনগুলি সুখ-স্বপ্নের মত অতিবাহিত হইয়া গেল। আরও কিছুদিন এখানে থাকিবার কথা ছিল, কিন্তু উপেন্দ্রর দেহের প্রতি লক্ষ্য করিয়া সাবিত্রী ত্রয়োদশীর দিন যাত্রা করিবার জন্য দিন স্থির করিয়া ফেলিল। উপেন্দ্রর আপত্তির বিরুদ্ধে জিদ করিয়া বলিল, সে হবে না দাদা। সতীশবাবুর অসুখ আর নেই, কিন্তু, তাঁর শরীর সবল হবার জন্যে অপেক্ষা করতে গেলে তোমাকে আর খুঁজে পাব না। পরশু আমাদের যেতেই হবে, তুমি অমত করো না দাদা।
উপেন্দ্র মৃদু হাসিয়া কহিলেন, আচ্ছা, সে দেখা যাবে। কিন্তু, তা হলেই কি আমাকে খুঁজে পাবে দিদি?
সাবিত্রী তর্ক না করিয়া কাজে চলিয়া গেল। উপেন্দ্রর দিনগুলা এখানে শান্তিতে কাটিতেছিল, তাই যাবার জন্য তাঁহার তাড়া ছিল না এবং যাত্রার দিন যে সত্যিই এত আসন্ন হইয়াছে তাহাও বোধ করি তিনি বিশ্বাস করিলেন না, কিন্তু সতীশের মুখ শুকাইল। কারণ, এই জিদের সহিত তাহার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। ইহা যে কোন বাধা মানে না এবং যে-কেহ ইহার সংস্রবে আছে, তাহাকেই যে শেষ পর্যন্ত নত হইতে হয়, তাহা সে ভাল করিয়াই জানিত। সুতরাং ত্রয়োদশী যে কিছুতেই পার হইবে না, তাহাতে তাহার লেশমাত্র সংশয় রহিল না। কিন্তু, কোন কথা কহিল না। পরদিনও এ সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ নির্বাক হইয়া রহিল। তাহার সাক্ষাতেই বেহারী সজলনয়নে সাবিত্রীকে যখন প্রশ্ন করিল, আবার কতদিনে দেখা দেবে মা, তখনও সতীশ মৌন হইয়া রহিল।
সাবিত্রী সতীশের মুখের প্রতি কটাক্ষে চাহিয়া গাম্ভীর্যের সহিত বলিল, তোমার বাবুর যেদিন বিয়ে হবে বেহারী, তখন আবার দেখা হবে। অবিশ্যি তোমার বাবু যদি দয়া করে আনেন তবেই।
দিন-দশেক পূর্বে সরোজিনীকে লইয়া যাইবার জন্য জ্যোতিষ নিজে আসিলে উপেন্দ্রর মধ্যস্থতায় বিবাহের পাকা কথাবার্তাই হইয়া গিয়াছিল।
সতীশ কিছুমাত্র আপত্তি করে নাই, স্থির হইয়াছিল তাহার কালাশৌচ গত হইলেই বিবাহ হইবে। সাবিত্রী এখন সেই ইঙ্গিতই করিল এবং সতীশ চুপ করিয়াই শুনিল।
যাবার দিন সকালে উপেন্দ্র একটু চিন্তান্বিত হইয়াই প্রশ্ন করিলেন, তোর শরীর কি তেমন সুস্থ বোধ হচ্চে না, সতীশ? কাল থেকে যেন তোকে ভারী শুক্নো দেখাচ্চে।