এককড়ি কহিল, বাবু? আজ বাইশ দিন হলো, তিনি ত ভাল হয়ে গেছেন। মশায়, সমস্ত ওষুধ আমিই দিয়েচি। বলিয়া সে বার-কয়েক নিজের বুক নিজেই ঠুকিয়া দিল।
উপেন্দ্র অনেকটা নিশ্চিন্ত হইয়া প্রশ্ন করিলেন, অসুখটা কি খুব বেশী হয়েছিল, এককড়িবাবু?
এককড়ি কহিল, বেশী? তিনি ত মরেই গেছলেন। গিন্নীমা না এসে পড়লে ত শিবের অসাধ্যি ছিল। হবে না মশাই? দিনরাত থাকোবাবার সঙ্গে মদ আর মদ, গাঁজা আর গাঁজা। কি না কালীসিদ্ধ হচ্চে। ছাই হচ্চে! ও-সব কি আমরা ডাক্তারেরা বিশ্বাস করি মশাই? আমরা সায়েণ্টিফিক্ মেন। কিন্তু গিন্নীমা এসেই থাকোবাবার বাবাত্বি বের করে দিলেন—টান মেরে ত্রিশূল-ফ্রিশূল ফেলে দিয়ে দূর করে দিলেন। ব্যাটা দিন-কতক কি কম কাণ্ডই করলে! সেই যেন বাবু,—একে তেড়ে মারতে যায়, ওকে তেড়ে মারতে যায়,—একদিন সামান্য কথায় মশাই, আমাকে এমনি দাঁতঝাড়া দিয়ে উঠল! আমি নেহাত নাকি ভালমানুষ, কারো সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করতে চাইনে, নইলে, আর কেউ হলে দিত ব্যাটার মাথাটা সেদিন ফাটিয়ে। বলিয়া এককড়ি হাতের ছাতাটা একবার শূন্যে আস্ফালন করিয়া লইল।
উপেন্দ্র একটু আশ্চর্য হইয়াই জিজ্ঞাসা করিলেন, গিন্নীমা কে?
এককড়ি কহিল, তা কি জানি মশাই। সবাই বলে গিন্নীমা, আমিও বলি গিন্নীমা।
উপেন্দ্র কহিলেন, তাঁকে তুমি দেখেচ?
এককড়ি কহিল, হাঁ সে এক-রকম দেখাই বৈ কি।
উপেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, তাঁর বয়স কত বলতে পার?
এককড়ি একটু ভাবিয়া কহিল, তা চল্লিশ-পঞ্চাশ হবে বোধ হয়। নইলে বাবুকে কি কেউ শাসন করতে পারে মশাই? ডাক্তারবাবু ত বলেন, তিনি না এলে ত হয়েই গেছল।
এককড়ির সঙ্গে উপেন্দ্র যখন সতীশের বাটীতে আসিয়া পৌঁছিলেন তখন বেলা ডোবে-ডোবে। সরোজিনী পূর্বেই পৌঁছিয়াছিল, তাহার পালকি ফটকের বাহিরে বটগাছতলায় নামাইয়া দরোয়ান অপেক্ষা করিতেছে। সুমুখেই দাতব্য-চিকিৎসালয়, সেখানে লোকজনের অসম্ভব জনতা।
এককড়ি সকলকে সঙ্গে করিয়া আনিয়া নীচের বসিবার ঘরে বসাইয়া বেহারীকে ডাকিতে গেল, কিন্তু তাহার দেখা মিলিল না। ডাক্তারবাবুও বাহিরে রোগী দেখিতে গিয়াছিলেন, সমস্ত লোক ভিড় করিয়া তাঁহার জন্যই অপেক্ষা করিতেছে।
উপেন্দ্রর এই গিন্নীমা সম্বন্ধে অত্যন্ত সংশয় ছিল, তাই সরোজিনীকে সেইখানেই অপেক্ষা করিতে বলিয়া সোজা সুমুখের সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়া গেলেন।
সতীশ শয্যার উপর ঘুমাইতেছিল। তাহার শিয়রে বসিয়া সাবিত্রী জ্বরের কাগজখানা নিবিষ্ট-মনে পরীক্ষা করিতেছিল। ও-ধারের খোলা জানালা দিয়া সূর্যাস্ত-আভা মেঝের উপর রাঙ্গা হইয়া ছড়াইয়া পড়িয়াছিল।
এমনি সময় দ্বারের ভারী পর্দা সরানোর শব্দে সাবিত্রী মুখ তুলিয়া দেখিল—একজন অপরিচিত ভদ্রলোক।
শশব্যস্তে মাথায় আঁচল তুলিয়া দিয়া উঠিয়া পড়িবার চেষ্টা করিতেই আগন্তুক নিকটে আসিয়া কহিলেন, আপনি উঠবেন না-আমি উপেন। আপনি সাবিত্রী ত?
সাবিত্রী ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, হাঁ।কিন্তু ভয়ে, লজ্জায়, সঙ্কোচে একেবারে যেন মরিয়া গেল।
উপেন জিজ্ঞাসা করিলেন, সতীশ ঘুমুচ্চে? এখন কেমন আছে?
সাবিত্রী পূর্বেই মতই মাথা নাড়িয়া জানাইল, ভাল আছেন।
উপেন্দ্র তখন ধীরে ধীরে খাটের একাংশে আসিয়া বসিলেন। নিজের কর্তব্য তিনি পূর্বেই স্থির করিয়া লইয়াছিলেন, বলিলেন, আমাকে সে চিঠি যে আপনিই লিখেছিলেন তা এখন বুঝতে পারচি। আমাকে আসতে বলে নিজের সুখ-দুঃখ,ভাল-মন্দ যে আপনি কতখানি তুচ্ছ করেছিলেন, মনে করবেন না সে আমি বুঝিনি। এই ত চাই। এই ত নিজের পরিচয়।
সাবিত্রীর মনে হইল,সে বুঝি স্বপ্ন দেখিতেছে। এ বুঝি আর কেহ, এ বুঝি সতীশের সে উপীনদা নয়।
উপেন্দ্র ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন,তোমার চেয়ে আমি বয়সে বড়। তোমাকে আমি সাবিত্রী বলে ডাকব, তুমি আমাকে দাদা বলে ডেকো; আজ থেকে তুমি আমার ছোট বোন।
সাবিত্রী নীরবে উঠিয়া আসিয়া গলায় আঁচল দিয়া উপেন্দ্রর পায়ের কাছে প্রণাম করিল এবং দুই হাত বাড়াইয়া উপেন্দ্রর জুতার ফিতা খুলিতে খুলিতে অধোমুখে প্রশ্ন করিল, আসতে এত দেরী হলো কেন? চিঠি কি সময়ে পাননি?
উপেন্দ্র সাবিত্রীর কাজে বাধা দিলেন না। সহজভাবে বলিলেন, না ভাই, পাইনি। আমি পরশু পুরীতে তোমার চিঠি পেয়ে আসচি। কিন্তু তোমার যে একটা ভারী শক্ত কাজ বাকী রয়েচে দিদি,—কথাটা এইখানে উপেন্দ্রর মুখে বাধিয়া গেল।।
সাবিত্রী জুতাজোড়াটা একপাশে সরাইয়া রাখিয়া মোজা খুলিতে খুলিতে বলিল, কি কাজ দাদা?
তথাপি উপেন্দ্রর মুখে একবার বাধিল। তার পর যেন জোর করিয়াই ভিতরের সঙ্কোচ কাটাইয়া বলিলেন, কিন্তু তুমি ছাড়া এ কাজ আর কারুর সাধ্য নয় করে। আর একজন পারত, সে সুরবালা—
সাবিত্রী মৌনমুখে অপেক্ষা করিয়া আছে দেখিয়া উপেন্দ্র কহিলেন,সরোজিনীর নাম শুনেচ?
সাবিত্রী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, শুনেচি।
সমস্তই শুনেচ বোধ হয়?
সাবিত্রী তেমনিই মাথা নাড়িয়া জানাইল, সে সমস্তই জানে।
তখন উপেন্দ্র ধীরে ধীরে বলিলেন, সতীশের অসুখ শুনে তাকে কোনমতেই ধরে রাখা গেল না, আমার সঙ্গে সে এসেচে। নীচের ঘরে অপেক্ষা করে বসে আছে,—তার কোন উপায় কর দিদি।
সাবিত্রী ত্রস্তপদে উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, তিনি এসেছেন! আমি এখুনি গিয়ে—কিন্তু আমি কি তাঁর কাছে যেতে পারি দাদা?
এ ইঙ্গিত উপেন্দ্র বুঝিলেন। দুই চক্ষু প্রসারিত করিয়া মুক্তকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন,তুমি যেতে পারো না? আমার ছোটবোন সংসারে কি কোন মেয়ের চেয়ে ছোট সাবিত্রী, যে, কোথাও তার মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সঙ্কোচ হবে? আমার বোন,পৃথিবীতে সে কি সোজা পরিচয় দিদি!