বেহারী উদ্বিগ্ন হইয়া বলিল, আমি! কিন্তু আমার সেই কোমরের বাতটা—
তবে কি হবে বেহারী—
বেহারী একটুখানি ভাবিয়া বলিল, আজ যদি তুমি ঠাকুরমশাইকে হুকুম দিয়ে—
সাবিত্রী তাড়াতাড়ি বলিল, সে হবে না বেহারী। বামুন মানুষকে আমি শীতে কষ্ট দিতে পারব না।
অনিচ্ছুক বেহারী ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া বলিল, আচ্ছা, আমিই না হয় থাকব। তবে চল, তোমাকে রেখে আসি।
সাবিত্রী উঠিয়া দাঁড়াইল। দুই-এক পা অগ্রসর হইয়া থামিয়া বলিল, কাজ নেই বেহারী, তুমি খেয়ে নাও গে—তার পরেই যাব।
বেহারী চলিয়া গেলে সাবিত্রী সেইখানেই ফিরিয়া আসিয়া বসিল, এবং অন্ধকার আকাশের পানে চাহিয়া চুপ করিয়া রহিল। আজ সতীশের সম্বন্ধে তাহার যথেষ্ট আশঙ্কা ছিল। সে মাতালের হাতে পড়িয়াছে, ইহা চোখে দেখিয়া তাহার কোনমতেই ঘরে ফিরিতে মন সরিতেছিল না। যদিচ, ইতিপূর্বে ইহারই নির্বুদ্ধিতায় নিদারুণ লাঞ্ছিত হইয়া জ্বালায় ছটফট করিয়া সে প্রত্যুষেই কর্মত্যাগের সঙ্কল্প স্থির-নিশ্চয় করিয়া রাখিয়াছিল, কিন্তু আজ রাত্রের মত এই লোকটিকে মনে মনে ক্ষমা না করিয়া, তাহার অবশ্যম্ভাবী দুর্গতির কোন একটা উপায় না করিয়া সে কোনমতেই ঘরে ফিরিতে পারিল না। বেহারী খাইয়া আসিলে বলিল, তুমি শুতে যাও বেহারী, আমিই আছি।
বেহারী আশ্চর্য হইয়া বলিল, ঘরে যাবে না?
বাবু ফিরে আসুন। তার পরে আমাকে রেখে আসতে পারবে না?
কেন পারব না মা? নিশ্চয় পারব।
তবে সেই ভাল। আমি আছি, তুমি শোও গে।
বেহারী খুশী হইয়া চলিয়া গেলে সাবিত্রী সেইখানেই একটা র্যা পার গায়ে দিয়া বসিয়া রহিল। এই মাতাল দুটো যাহা চোখে দেখিয়া গিয়াছে, তাহা প্রকাশ করিবেই ইহাতেও তাহার যেমন লেশমাত্র সংশয় ছিল না, এ ঘটনার দ্বিতীয় অর্থও যে কেহ গ্রহণ করিবে না, ইহাতেও তাহার তেমনি সন্দেহ রহিল না। বিপিনবাবু লোকটিকে সাবিত্রী জানিত। সে এ কথা নিশ্চয় শুনিবে এবং এ বাসায় যখন তাহার গতিবিধি আছে তখন কেহই বঞ্চিত থাকিবে না। তাহার পরেও আর কোন্ মুখে সতীশ এখানে একদণ্ডও থাকিবে! এই অভিশস্তির লজ্জা সে কি করিয়া সহ্য করিবে? দৈবাৎ যাহা ঘটিয়া গেল, তাহা ত গেলই; নিজের সম্বন্ধে সে এইখানে থামিল বটে, কিন্তু পুনঃ পুনঃ আলোচনা করিয়াও সতীশের সম্বন্ধে কোন বুদ্ধিই খুঁজিয়া পাইল না।
ক্রমশঃ রাত্রি বাড়িতে লাগিল, অথচ সতীশের দেখা নাই। নিকটে কোন প্রতিবেশীর ঘরের ঘড়িতে টং-টং করিয়া দুটা বাজিয়া গেল—নিস্তব্ধ গভীর রাত্রে তাহা স্পষ্ট শোনা গেল। এলোমেলো শীতল বায়ু খোলা ছাদের উপর দিয়া বহিয়া আসিয়া তাহার দুটি চক্ষুকে ঘুমে চাপিয়া ধরিতে লাগিল, তথাপি সে জাগিয়া থাকিয়া বাহির-দরজায় কান পাতিয়া রাখিল। এমনি করিয়া শুইয়া বসিয়া রাত যখন আর বড় বাকী নাই, এমন সময়ে একখানা গাড়ির শব্দে চকিত হইয়া উঠিয়া বসিয়াই বুঝিল গাড়ি তাহাদেরই বাসার সম্মুখে দাঁড়াইয়াছে। সাবিত্রী নিঃশব্দে নামিয়া গিয়া দরজার পার্শ্বে আসিয়া সর্তক হইয়া দাঁড়াইল। পাছে আর কেহ থাকে এই ভয়ে সহসা খুলিতে সাহস করিল না। বিলম্ব হইতে লাগিল, কেহ দরজায় ঘা দিল না। যে গাড়িখানা আসিয়াছিল তাহাও ফিরিয়া গেল। অকস্মাৎ সাবিত্রী আশঙ্কায় পরিপূর্ণ হইয়া ক্ষিপ্রহস্তে অর্গল মুক্ত করিয়া ফেলিল। সতীশ বাহিরের চৌকাঠে হেলান দিয়া পাংশুমুখে চোখ বুজিয়া বসিয়া আছে। তাহার কাপড়ে চাদরে কাদা, মাথা এবং কপালের একধারে রক্তের রেখা অদূরবর্তী গ্যাসের আলোকে স্পষ্ট দেখিতে পাইয়া সাবিত্রী কাঁদিয়া ফেলিল। চক্ষের নিমেষে তাহার সম্মুখে আসিয়া হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া দুই হাতে সতীশের মুখ তুলিয়া ধরিয়া বলিল, বাবু, ওপরে চলুন।
সতীশ মাথা নাড়িয়া বলিল, না, বেশ আছি।
সাবিত্রী চোখ মুছিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কোথাও লেগেছে?
না, লাগেনি, বেশ আছি।
এ যে রাস্তা, ঘরে চলুন।
সতীশ পুনর্বার মাথা নাড়িয়া বলিল, না, যাব না, বেশ আছি।
সাবিত্রী ধমক দিয়া বলিল, উঠুন বলছি।
ধমক খাইয়া সতীশ রক্তবর্ণ বিহ্বল-চক্ষে খানিকক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া তাহার দিকে দুই হাত বাড়াইয়া বলিল, চল।
তখন তাহারি কাঁধে ভর দিয়া সতীশ উঠিয়া দাঁড়াইল এবং তাহাকেই আশ্রয় করিয়া বহু ক্লেশে বহু বিলম্বে টলিতে টলিতে অন্ধকার সিঁড়ি বাহিয়া ঘরে আসিয়া শুইয়া পড়িল। জড়িত-কণ্ঠে বলিতে লাগিল, সাবিত্রী, তোমার ঋণ আমি কোন জন্মে শুধতে পারব না।
সাবিত্রী বলিল, আচ্ছা, আপনি ঘুমোন।
সতীশ চোখের নিমেষে উঠিয়া বসিয়া বলিল, কি ঘুমোব? কখ্খন না।
পুনর্বার সাবিত্রী ধমক দিয়া উঠিল, আবার!
সতীশ শুইয়া পড়িল। ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, কিন্তু তোমার ধার—
সাবিত্রী ‘আচ্ছা’ বলিয়া উঠিয়া গেল এবং আলো কাছে আনিয়া ক্ষত পরীক্ষা করিয়া ধুইয়া দিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কোথায় পড়ে গেলেন?
সতীশ মাথা নাড়িয়া বলিল, না, পড়িনি।
সাবিত্রী সজল-কণ্ঠে বলিল, আর যদি কোনদিন মদ খান আপনার পায়ে মাথা খুঁড়ে মরব।
সতীশ তৎক্ষণাৎ বলিল, কোনদিন খাব না।
আমাকে ছুঁয়ে দিব্যি করুন, বলিয়া সাবিত্রী তাহার দক্ষিণ হস্ত বাড়াইয়া দিল।
সতীশ নিজের দুই হাতের মধ্যে তাহার জলসিক্ত শীতল হাতখানি টানিয়া লইয়া বলিল, দিব্যি কচ্ছি।
সাবিত্রী হাত টানিয়া লইয়া বলিল, মনে থাকবে?
না থাকলে তুমি মনে করে দিয়ো।
আচ্ছা, আমি আসচি আপনি ঘুমোন, বলিয়া সাবিত্রী নিঃশব্দে সাবধানে কবাট বন্ধ করিয়া বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। ঠিক সুমুখেই শুকতারা দপদপ করিয়া জ্বলিতেছিল, সেইদিকে চাহিয়া সাবিত্রী দুই হাত জোড় করিয়া কাঁদিয়া বলিল, ঠাকুর! তুমি সাক্ষী থেকো।