সরযূ বলিল, খোকা, খেলা কর গে।
বিশু শয্যা হইতে নামিয়া পড়িতেছিল, চন্দ্রনাথ সযত্নে তাহাকে নামাইয়া দিল। ইতিপূর্বে সে জননীকে প্রণাম করিতে দেখিয়াছিল, তাই নামিয়াই পিতার চরণপ্রান্তে ঢিপ্ করিয়া প্রণাম করিয়া ছুটিয়া পলাইল। চন্দ্রনাথ হাত বাড়াইয়া ধরিতে গেল, কিন্তু সে ততক্ষণে স্পর্শের বাহিরে আসিয়া পড়িয়াছিল।
সরযূ তাহার বুকের কাছে হাত দিয়া কহিল, শরীরে যে তোমার কিছু নেই, অসুখ হয়েছিল?
না, অসুখ হয়নি।
তবে বড় বেশি ভাবতে বুঝি?
চন্দ্রনাথ তাহার মুখপানে চাহিয়া বলিল, তোমার কি মনে হয়?
সরযূ সে কথার উত্তর দিল না, অন্য কথা পাড়িল—বেলা হয়েচে, স্নান করবে চল।
চন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করিল, বাড়ির কর্তা কোথায়?
তিনি আজ মন্দিরে পূজো করতে গেছেন, বোধ করি, সন্ধ্যার পরে আসবেন।
তুমি তাঁকে কি ব’লে ডাক?
বরাবর জ্যাঠামশায় বলে ডাকি, এখনও তাই বলি।
চন্দ্রনাথ আর কিছু জিজ্ঞাসা করিল না।
সরযূ জিজ্ঞাসা করিল, সঙ্গে কারা এসেছে?
হরি আর মধু এসেচে। তারা ডাকবাংলায় আছে।
এখানে আনতে বুঝি সাহস হ’ল না?
চন্দ্রনাথ এ কথার উত্তর দিল না।
চন্দ্রনাথ আহারে বসিয়া সুমুখে একথালা লুচি দেখিয়া কিছু বিস্মিত হইল। অপ্রসন্নভাবে ঠেলিয়া দিয়া বলিল, এ আবার কি? কুটুম্বিতে করচো, না তামাশা করচো?
সরযূ অপ্রতিভ হইয়া পড়িল। মলিন-মুখে বলিল, খাবে না?
চন্দ্রনাথ ক্ষণকাল সরযূর মুখপানে চাহিয়া বলিল, দুপুরবেলা কি আমি লুচি খাই?
সরযূ মনে মনে বিপদ্গ্রস্ত হইয়া মৌন হইয়া রহিল।
চন্দ্রনাথ কহিল, আজ যে তুমি আমাকে প্রথম খেতে দিলে তা নয়; আমি কি খাই, তাও বোধ করি ভুলে যাওনি।
সরযূর চোখে জল আসিতেছিল; ভাবিতেছিল, সেই দিন যে ফুরাইয়া গিয়াছে,—কহিল, ভাত খাবে? কিন্তু—
কিন্তু কি? শুকিয়ে গেছে?
না, তা নয়,—আমি এখানে রাঁধি!
বাড়িতেও ত রাঁধতে?
সরযূ একটু থামিয়া কহিল, আমার হাতে খাবে?
এইবার চন্দ্রনাথ মুখ নত করিল। এতক্ষণ তাহার মনে হয় নাই যে, সরযূ পর হইয়া গিয়াছে, কিংবা তাহার স্পর্শিত অন্নব্যঞ্জন আহার করা যায় না। কিন্তু সরযূর কথার ভিতর বড় জ্বালা ছিল। বহুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল, তারপর ধীরে ধীরে কহিল, সরযূ, দুপুরবেলা আমার চোখের জল না দেখলে কি তোমার তৃপ্তি হবে না? সরযূ তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইল—যাই, তবে আনি গে। রন্ধনশালায় প্রবেশ করিয়া সে বড় কান্না কাঁদিল, তার পর চক্ষু মুছিল, জল দিয়া ধুইয়া ফেলিল, আবার অশ্রু আসে, আবার মুছিতে হয়, সরযূ আর আপনাকে কিছুতে সামলাইতে পারে না। কিন্তু স্বামী অভুক্ত বসিয়া আছেন, তখন অন্নের থালা লইয়া উপস্থিত হইল। কাছে বসিয়া, বহুদিন পূর্বের মত যত্ন করিয়া আহার করাইয়া উচ্ছিষ্ট পাত্র হাতে লইয়া, আর একবার ভাল করিয়া কাঁদিবার জন্য রন্ধনশালায় প্রবেশ করিল।
বেলা দুইটা বাজিয়াছে। চন্দ্রনাথের ক্রোড়ের কাছে বিশ্বেশ্বর পরম আরামে ঘুমাইয়াছে। সরযূ প্রবেশ করিল।
চন্দ্রনাথ কহিল, সমস্ত কাজকর্ম সারা হ’ল?
কাজ কিছুই ছিল না। জ্যাঠামশাই এখনও আসেন নি। তাহার পর সরযূ ঘরকন্নার কথা পাড়িল। বাড়ির প্রতি ঘর, প্রতি সামগ্রী, মাতুল-মাতুলানী, দাস-দাসী, সরকারমশায়, হরিবালা সই, পাড়া-প্রতিবেশী, একে একে সমস্ত কথা জিজ্ঞাসা করিল। এই সময়টুকুর মধ্যে দু’জনের কাহারও মনে পড়িল না যে, সরযূর এ-সব জানিয়া লাভ নাই, কিংবা এ-সকল সংবাদ দিবার সময় চন্দ্রনাথেরও ক্লেশ হওয়া উচিত—একটু লজ্জা, একটু বিমর্ষতা, একটু সঙ্কোচের আবশ্যক। একজন পরম আনন্দে প্রশ্ন করিতেছে, অপরে উৎসাহের সহিত উত্তর দিতেছে। নিতান্ত বন্ধুর মত দুইজনে যেন পৃথক হইয়াছিল, আবার মিলিয়াছে।
সহসা সরযূ জিজ্ঞাসা করিল, বিয়ে করলে কোথায়?
এটা যেন নিতান্ত পরিহাসের কথা!
চন্দ্রনাথ বলিল, পশ্চিমে।
কেমন বৌ হ’ল?
তোমার মত।
এই সময় সরযূ বুকের কাছে একটা ব্যথা অনুভব করিল, সামলাইতে পারিল না, বসিয়া ছিল, শুইয়া পড়িল। মুখখানি একেবারে বিবর্ণ হইয়া গেল।
ব্যস্ত হইয়া চন্দ্রনাথ নীচে নামিয়া পড়িল, কাছে আসিয়া হাত ধরিয়া তুলিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু সরযূ একেবারে এলাইয়া পড়িয়াছিল। তখন শিয়রে বসিয়া ক্রোড়ের উপর তাহার মাথাটা তুলিয়া কাঁদ-কাঁদ হইয়া ডাকিল, সরযূ!
সরযূ চোখ বুজিল। তাহার ওষ্ঠাধর কাঁপিয়া উঠিল এবং অস্পষ্ট কি বলিল, বোঝা গেল না।
চন্দ্রনাথ অত্যন্ত ভয় পাইয়া জলের জন্য হাঁকাহাঁকি করিতে লাগিল। লখীয়ার মা নিকটেই ছিল, জল লইয়া ঘরে ঢুকিল, কিন্তু কোনরূপ ব্যস্ততা প্রকাশ করিল না। বলিল, বাবু, এখনি সেরে যাবে, অমন মাঝে মাঝে হয়।
তাহার পর মুখে চোখে জল দেওয়া হইল, বাতাস করা হইল, বিশু আসিয়া বার-দুই চুল ধরিয়া টানাটানি করিয়া ডাকিল, মা!
সরযূর চৈতন্য হইল, লজ্জিত হইয়া মাথায় কাপড় টানিয়া দিয়া উঠিয়া বসিল। লখীয়ার মা আপনার কাজে চলিয়া গেল। ভয়ে চন্দ্রনাথের মুখ কালি হইয়া গিয়াছিল।
সরযূ হাসিল। বড় ক্ষীণ, অথচ বড় মধুর হাসিয়া বলিল, ভয় পেয়েছিলে?
চন্দ্রনাথের দুই চোখে জল টলটল করিতেছিল, এইবারে গড়াইয়া পড়িল, হাত দিয়া মুছিয়া ফেলিল; বলিল, ভেবেছিলাম বুঝি সব শেষ হয়ে গেল।
সরযূ মনে মনে ভাবিল, তোমার কোলে মাথা ছিল—সে সুকৃতি কি এ হতভাগিনীর আছে? প্রকাশ্যে কহিল, এমন ধারা মাঝে মাঝে হয়।
তা দেখচি! তখন হ’ত না, এখন হয়, সেও বুঝি। বলিয়া চন্দ্রনাথ বহুক্ষণ নিঃশব্দে স্থির হইয়া বসিয়া রহিল। তাহার পর পকেট হইতে মরিচা-ধরা একটা চাবির গোছা বাহির করিয়া সরযূর আঁচলের খুঁটে বাঁধিয়া দিয়া বলিল, এই তোমার চাবির রিং—আমার কাছে গচ্ছিত রেখে চ’লে এসেছিলে, আজ আবার ফিরিয়ে দিলাম। চেয়ে দেখ, কখন কি ব্যবহার হয়েচে ব’লে মনে হয়?