পরদিন চন্দ্রনাথ কলিকাতায় আসিল। সঙ্গে মাতুল ব্রজকিশোরও আসিয়াছিলেন। কন্যা দেখা শেষ হইলে ব্রজকিশোর বলিলেন, কন্যাটি দেখিতে মা-লক্ষ্মীর মত।
চন্দ্রনাথ মুখ ফারাইয়া রহিল, কোনও মতামত প্রকাশ করিল না।
স্টেশনে আসিয়া টিকিট লইয়া দুইজনে গাড়িতে উঠিলে ব্রজকিশোর জিজ্ঞাসা করিলেন, তবে বাবাজী, পছন্দ হয়েছে ত?
চন্দ্রনাথ মাথা নাড়িয়া বলিল, না।
ব্রজকিশোর যেন আকাশ হইতে পড়িলেন,—এমন মেয়ে, তবু পছন্দ হ’ল না?
চন্দ্রনাথ মাথা নাড়িয়া বলিল, না।
ব্রজকিশোর মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন, তিনি সরযূকে দেখেন নাই।
তাহার পর নির্দিষ্ট স্টেশনে ট্রেন থামিলে ব্রজকিশোর নামিয়া পড়িলেন। চন্দ্রনাথ এলাহাবাদের টিকিট লইয়াছিল।
ব্রজকিশোর বলিলেন, তবে কতদিনে ফিরবে?
কাকাকে প্রণাম জানিয়ে বলবেন, শীঘ্র ফেরবার ইচ্ছা নেই।
মণিশঙ্কর সে কথা শুনিয়া কপালে করাঘাত করিয়া কহিলেন, যা হয় হবে। আমার দেহটা একটু ভাল হ’লেই নিজে গিয়ে বউমাকে ফিরিয়ে আনব। মিথ্যা সমাজের ভয় ক’রে চিরকাল নরকে পচতে পারব না—আর সমাজই বা কে? সে ত আমি নিজে।
হরকালী এ সংবাদ শুনিয়া দন্তে দন্তে ঘর্ষণ করিয়া বলিলেন, মরবার আগে মিন্সের বায়াত্তুরে ধরেচে! সরকারকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, চন্দ্রনাথ কি বললে?
সরকার কহিল, আজ পর্যন্ত কত টাকা কাশীতে পাঠানো হয়েচে?
শুধু এই জিজ্ঞেস করেছিল—আর কিছু না?
না।
হরকালী মুখের ভাব অতি ভীষণ করিয়া চলিয়া গেলেন।
চন্দ্রনাথ – ১৬-২০
ষোড়শ পরিচ্ছেদ
চন্দ্রনাথ এলাহাবাদের টিকিট কিনিয়াছিল, কিন্তু পথিমধ্যে অকস্মাৎ সঙ্কল্প পরিবর্তন করিয়া কাশী আসিয়া উপস্থিত হইল।
সঙ্গে যে দুইজন ভৃত্য ছিল, তাহারা গাড়ি ঠিক করিয়া জিনিসপত্র তুলিল; কিন্তু চন্দ্রনাথ তাহাতে উঠিল না; উহাদিগকে ডাকবাংলায় অপেক্ষা করিয়া থাকিবার হুকুম দিয়া পদব্রজে অন্য পথে চলিয়া গেল। পথে চলিতে তাহার ক্লেশ বোধ হইতেছিল। মুখ শুষ্ক, বিবর্ণ, নিজের প্রতি পদক্ষেপ নিজের বুকের উপরেই যেন পদাঘাতের মত বাজিতে লাগিল, তথাপি চন্দ্রনাথ চলিতে লাগিল, থামিতে পারিল না। ক্রমেই হরিদয়ালের বাটীর দূরত্ব কমিয়া আসিতেছে। এ সমস্তই যে তাহার বিশেষ পরিচিত পথ! গলির মোড়ের সেই ছোট চেনা দোকানটি—ঠিক তেমনি রহিয়াছে। দোকানের মালিক ঠিক তত বড় ভুঁড়িটি লইয়াই মোড়ার উপর বসিয়া ফুলুরি ভাজিতেছে। চন্দ্রনাথ একবার দাঁড়াইল, দোকানদার চাহিয়া দেখিল, কিন্তু সাহেবী পোশাক-পরা লোকটিকে সাহস করিয়া ফুলুরি কিনিতে অনুরোধ করিতে পারিল না, একবার চাহিয়াই সে নিজের কাজে মন দিল।
চন্দ্রনাথ চলিয়া গেল। এই মোড়ের শেষে—আর ত তাহার পা চলে না। সঙ্কীর্ণ কাশীর পথে যেন বিন্দুমাত্র বাতাস নাই, শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্লেশ হইতেছে, দুই-এক পা গিয়া সে দাঁড়ায়—আবার চলে, আবার দাঁড়ায়, পথ আর ফুরায় না, তথাপি মনে হয়, এ পথ যেন না ফুরায়! পথের শেষে না জানি কিবা দেখিতে হয়! তারপর হরিদয়ালের বাটীর সম্মুখে আসিয়া সে দাঁড়াইল। বহুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল, ডাকিতে চাহিল, কিন্তু গলা শুকাইয়া গিয়াছে।
বদ্ধ-স্বর, ভগ্ন-শব্দ করিয়া থামিয়া গেল। ঘড়ি খুলিয়া দেখিল, নয়টা বাজিয়া গিয়াছে, তখন সাহস করিয়া ডাকিল, ঠাকুর, দয়ালঠাকুর! কেহ উত্তর দিল না। পথ দিয়া যাহারা চলিয়া যাইতেছিল, অনেকেই চন্দ্রনাথের রীতিমত সাহেবী পোশাক দেখিয়া ফিরিয়া চাহিল। চন্দ্রনাথ আবার ডাকিল, দয়ালঠাকুর!
এবার ভিতর হইতে স্ত্রী-কণ্ঠে উত্তর আসিল, ঠাকুর বাড়ি নেই।
যে উত্তর দিল সে একজন বাঙ্গালী দাসী।
সে দ্বার পর্যন্ত আসিয়া চন্দ্রনাথের পোশাক-পরিচছদ দেখিয়া লুকাইয়া পড়িল কিন্তু মাতৃভাষায় কথা কহিতে শুনিয়া একেবারে ভয়ে অভিভূত হইয়া পলাইয়া গেল না। অন্তরাল হইতে বলিল, ঠাকুর বাড়ি নেই।
কখন আসবেন?
দুপুরবেলা।
চন্দ্রনাথ ভিতরে প্রবেশ করিল। আনন্দ, শঙ্কা ও লজ্জা তিনের সংমিশ্রণে বুকের ভিতর কাঁপিয়া উঠিল—ভিতরে সরযূ আছে। কিন্তু ভিতরে প্রবেশ করিয়া আর কাহাকেও দেখিতে পাইল না। জিজ্ঞাসা করিল, বাড়িতে আর কেউ নেই?
না।
তারা কোথা?
কারা?
একজন স্ত্রীলোক—
এই আমি ছাড়া আর ত কেউ এখানে নাই!
একটা ছোট ছেলে?
না, কেউ না।
চন্দ্রনাথ পইঠার উপরে বসিয়া পড়িল, এরা তবে গেল কোথায়?
দাসী বিব্রত হইয়া পড়িল। বলিল, না গো, এখানে কেউ থাকে না। আমি আর ঠাকুরমশাই থাকি। এক মাসের মধ্যে কোন যজমানও আসেনি।
চন্দ্রনাথ স্তব্ধ হইয়া মাটির দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল। মনে যে-সব কথা উঠিতেছিল, তাহা অন্তর্যামীই জানেন। বহুক্ষণ পরে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কতদিন এখানে আছ?
প্রায় দেড় বছর।
তবুও কাউকে দেখনি? একজন গৌরবর্ণ স্ত্রীলোক আর একটি ছেলে, না হয় মেয়ে, না হয় শুধু ঐ স্ত্রীলোকটি, কেউ না, কাউকে দেখনি?
না, আমি কাউকে দেখিনি।
কারো মুখে কোন কথা শোননি?
না
চন্দ্রনাথ আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিল না। সেইখানে দয়ালঠাকুরের অপেক্ষা করিয়া বসিয়া রহিল। তাহার সেই সরযূ আর বাঁচিয়া নাই, তাহা সে বেশ বুঝিতেছিল, তথাপি শুনিয়া যাওয়া উচিত, এই জন্যই বসিয়া রহিল। এক-একটি মিনিট এক-একটি বৎসর বলিয়া বোধ হইতে লাগিল।
দ্বিপ্রহর উত্তীর্ণ হইলে হরিদয়াল ঠাকুর বাটী আসিলেন। প্রথম দৃষ্টিতে তিনি চমকিত হইলেন, পরে চিনিতে পারিয়া শুষ্কস্বরে কহিলেন, তাইত, চন্দ্রবাবু যে, কখন এলেন?