সুরেশ একটু হাসিয়া বলিল, দুনিয়ায় আমার সাহস হয় না, এমন ভয়ঙ্কর আশ্চর্য বস্তু আবার কি ছিল, এ ত তুমি ভাবচো? ভাবতে পারো—আমিও অনেক ভেবেচি। এর মানে যদি কিছু থাকে, একদিন ত প্রকাশ পাবেই। কিন্তু অনেক অপমান, অনেক দুঃখের বোঝাই ত সংসারে তুমি আমার কাছে অর্থ না বুঝেই নিয়েচ—একে তেমনি নাও অচলা।
অচলা শান্তকণ্ঠে প্রশ্ন করিল, এর মধ্যে কি আছে?
সুরেশ হাতজোড় করিয়া কহিল, এতদিন যা কিছু তোমার কাছে পেয়েছি, ডাকাতের মত জোর করেই পেয়েছি। কিন্তু আজ শুধু একটি জিনিস ভিক্ষে চাইচি—এ কথা তুমি জানতে চেয়ো না।
অচলা চুপ করিয়া রহিল, ইহার পরে কি বলিবে, ভাবিয়া পাইল না।
বাহিরে পর্দার আড়াল হইতে বেহারা ডাকিয়া কহিল, বাবুজী, এক্কাওয়ালা বলচে, আর দেরি করলে পৌঁছুতে রাত্রি হয়ে যাবে। পথে হয়ত ঝড়বৃষ্টিও হতে পারে।
অচলা চকিত হইয়া কহিল, আজ আবার তুমি কোথায় যাবে? এমন সময়ে?
সুরেশ হাসিমুখে সংশোধন করিয়া কহিল, অর্থাৎ এমন অসময়ে। যাচ্ছি ওই মাঝুলিতেই। প্লেগের ডাক্তার কিছুতে পাওয়া যাচ্ছে না, অথচ গ্রামগুলো একেবারে শ্মশান হয়ে পড়েচে। এবার পাঁচ-সাত দিন থাকবে হবে—আর কে জানে, হয়ত একেবারেই বা থেকে যেতে হবে। বলিয়া সে আবার একটু হাসিল।
অচলা স্থির হইয়া তাহার মুখের পানে চাহিয়া রহিল। সে নিজেও কিছু কিছু সংবাদ জানিত; সাত-আট ক্রোশ দূরে কতকগুলা গ্রাম যে সত্যই এ বৎসরে প্লেগে শ্মশান হইয়া যাইতেছে, এ খবর সে শুনিয়াছিল। শহর হইতে এতদূরে এই ভীষণ মহামারীতে দরিদ্রের চিকিৎসা করিতে যে চিকিৎসকের অভাব ঘটিবে, ইহাও বিচিত্র নয়। সুরেশ বহু টাকার ঔষধ-পথ্য যে গোপনে দিকে দিকে প্রেরণ করিতেছে, ইহাও সে টের পাইয়াছিল; এবং নিজেও প্রায় ভোরে উঠিয়া কোথাও-না-কোথাও চলিয়া যায়। ফিরিতে কখনো সন্ধ্যা, কখনো রাত্রি হয়—পরশু ত আসিতে পারে নাই, কিন্তু সে যে বাড়ি ছাড়িয়া, তাহাকে ছাড়িয়া, একেবারে কিছুদিনের মত সেই মরণের মাঝখানে গিয়া বাস করিবার সঙ্কল্প করিবে, ইহা সে কল্পনাও করে নাই। তাই কথাটা শুনিয়া ক্ষণকালের জন্য সে কেবল নিঃশব্দে তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল। এই যে মহাপাপিষ্ঠ, যে ভগবান মানে না, পাপ-পুণ্য মানে না, যে কেবলমাত্র বন্ধু ও তাহার নিরপরাধা স্ত্রীর এত বড় সর্বনাশ অবলীলাক্রমে সাধিয়া বসিল, কোন বাধা মানিল না—তাহার মুখের প্রতি সে যখনই চাহিয়াছে, তখনই সমস্ত মন বিতৃষ্ণায় বিষ হইয়া গিয়াছে—কিন্তু আজ এই মুহূর্তে তাহারই পানে চাহিয়া সমস্ত অন্তর তাহার বিষে নয়, অকস্মাৎ বিস্ময়ে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। ওই লোকটির ওষ্ঠের কোণে তখনও একটুখানি হাসির রেখা ছিল—অত্যন্ত ক্ষীণ, কিন্তু সেইটুকু হাসির মধ্যেই যেন অচলা বিশ্বের সমস্ত বৈরাগ্য ভরা রহিয়াছে দেখিতে পাইল। মুখে তাহার উদ্বেগ নাই, উত্তেজনা নাই, এই যে মৃত্যুর মধ্যে গিয়া নামিয়া দাঁড়াইতে যাত্রা করিয়াছে—তথাপি মুখের উপর শঙ্কার চিহ্নমাত্র নাই। তবে এই নিরীশ্বর ঘোর স্বার্থপরের কাছেও কি তাহার নিজের প্রাণটা এতই সস্তা! সংসারে ভোগ ছাড়া যে লোক আর কিছুই বুঝে না—ভোগের সমস্ত আয়োজনের মধ্যে মগ্ন রহিয়াও কি বাঁচিয়া থাকাটা তাহার এমনি অকিঞ্চিৎকর, এমনি অবহেলার বস্তু যে, এতই সহজে সমস্ত ছাড়িয়া যাইতে এক নিমিষে প্রস্তুত হইয়া দাঁড়াইল? হয়ত না ফিরিতেও পারি! ইহা আর যাহাই হোক, পরিহাস নয়। কিন্তু কথাটা কি এতই সহজে বলিবার?
অকস্মাৎ ভিতরের ধাক্কায় সে যেন চঞ্চল হইয়া উঠিল; হাতের কাগজখানা দেখাইয়া প্রশ্ন করিল, এটা কি তোমার উইল?
সুরেশও প্রশ্ন করিল, যা এইমাত্র ভিক্ষে দিলে অচলা, তাই কি তবে ফিরে নিতে চাও?
অচলা একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, আচ্ছা, আমি জানতে চাইনে। কিন্তু আমি তোমাকে যেতে দিতে পারবো না।
কেন?
প্রত্যুত্তরে অচলা সেই খামখানাই পুনরায় নাড়াচাড়া করিয়া একটু ইতস্ততঃ করিয়া বলিল, তুমি আমার যাই কেননা করে থাকো, আমার জন্যে তোমাকে আমি মরতে দেবো না।
সুরেশ জবাব দিল না। অচলা নিজের কথায় একটু লজ্জা পাইয়া কথাটাকে হালকা করিবার জন্য পুনশ্চ কহিল, তুমি বলবে, তোমার জন্যে মরতে যাবো কোন্ দুঃখে, আমি যাচ্চি গরীবদের জন্য প্রাণ দিতে, বেশ তাও আমি দেব না।
কথাটা শুনিয়াই দপ্ করিয়া সুরেশের মহিমকে মনে পড়িল এবং বুকের ভিতর হইতে একটা নিশ্বাস উত্থিত হইয়া স্তব্ধ ঘরের মধ্যে ছড়াইয়া পড়িল। কারণ জীবনের মমতা যে কত তুচ্ছ এবং কতই না সহজ, ইহাকে যে বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হইতে পারে, তাহার একটিমাত্র সাক্ষী আজও আছে, সে কেবল মহিম। আজিকার এই যাত্রাই যদি তাহার মহাযাত্রা হয় ত সেই সঙ্গীহীন একান্ত নীরব মানুষটিই কেবল মনে মনে বুঝিবে, সুরেশ লোভে নয়, ক্ষোভে নয়, ঘৃণায় নয়—ইহকাল-পরকাল কোন কিছুর আশাতে প্রাণ দেয় নাই, সে মরিয়াছে শুধু কেবল মরণটা আসিয়াছিল বলিয়াই।
চোখ-দুইটা তাহার জলে ভরিয়া আসিতে চাহিল, কিন্তু সংবরণ করিয়া ফেলিল। বরঞ্চ মুখ তুলিয়া একটুখানি হাসির চেষ্টা করিয়া বলিল, আমি কারও জন্যেই মরতে চাইনে অচলা! চুপ করে নিরর্থক বসে বসে আর ভাল লাগে না, তাই যাচ্ছি একটু ঘুরে বেড়াতে। মরব কেন অচলা, আমি মরব না।
তবে এ উইল কিসের জন্য?
কিন্তু এটা যে উইল, সে ত প্রমাণ হয়নি।