অনেক রাস্তা গলি ঘুরিয়া ক্লান্ত হইয়া, সুরেশ সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরিল। বসিবার ঘরে ঢুকিয়া আশ্চর্য হইয়া দেখিল, মহিম চোখের উপর হাত চাপা দিয়া একটা কোচের উপর পড়িয়া আছে, উঠিয়া বসিয়া কহিল, এস সুরেশ।
এই যে! বলিয়া সুরেশ ধীরে ধীরে কাছে আসিয়া একটা চৌকি টানিয়া বসিল।
মহিম কালেভদ্রে আসে। সুতরাং সে আসিলেই সুরেশের অভ্যর্থনা কিঞ্চিৎ উগ্র হইয়া উঠিত। আজ কিন্তু তাহার মুখ দিয়া আর কোন কথাই বাহির হইল না। মহিম মনে মনে বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিল, বাসায় ফিরে এসে শুনি, তুমি গিয়েছিলে। তাই মনে করলুম—
দয়া করে একবার দেখা দিয়ে আসি। না হে! কতদিন পরে এলে, মনে করতে পার?
মহিম হাসিয়া কহিল, পারি। কিন্তু সময় করে উঠতে পারিনি যে। বলিয়া লক্ষ্য করিয়া দেখিল, গ্যাসের আলোকে সুরেশের মুখের চেহারা অত্যন্ত ম্লান এবং কঠিন দেখাইতেছে। তাহাকে প্রসন্ন করিবার অভিলাষে স্নিগ্ধস্বরে পুনরায় কহিল, তোমার রাগ হতে পারে, এ আমি হাজার বার স্বীকার করি সুরেশ। কিন্তু বাস্তবিক সময় পাইনে। আজকাল পড়াশুনার চাপও একটু আছে, তা ছাড়া সকালে-বিকালে গোটা-দুই টিউশনি—
আবার টিউশনি নেওয়া হয়েছে?
মহিম তাহার ঠিক জবাবটা এড়াইয়া গিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আমাকে খুঁজেছিলে, বিশেষ কিছু দরকার ছিল কি?
সুরেশ কহিল, হুঁ। তুমি আজ না এলে আমাকে আবার কাল সকালে যেতে হত।
মহিম কারণ জানিবার জন্য জিজ্ঞাসুমুখে চাহিয়া রহিল। সুরেশ অনেকক্ষণ পর্যন্ত নিঃশব্দে তাহার পায়ের জুতাজোড়ার পানে চাহিয়া থাকিয়া কহিল, তুমি এর মধ্যে বোধ করি কেদারবাবুর বাড়িতে আর যাওনি?
মহিম কহিল, না।
কেন যাওনি, আমার জন্যে ত? আচ্ছা, তোমার সেই প্রতিশ্রুতি থেকে তোমাকে আমি মুক্তি দিলুম। তোমার ইচ্ছামত সেখানে যেতে পার।
মহিম হাসিল; যাব না, এমন প্রতিজ্ঞা করেছিলেম বলে ত আমার মনে হয় না!
সুরেশ বলিল, না হয় ভালই, তবুও আমার তরফ থেকে যদি কোন বাধা থাকে ত সে আমি তুলে নিলুম।
এটা অনুগ্রহ না নিগ্রহ, সুরেশ?
তোমার কি মনে হয় মহিম?
চিরকাল যা মনে হয়, তাই।
সুরেশ কহিল, তার মানে আমার খামখেয়াল! এই না? তা বেশ, তোমার যা ইচ্ছে মনে করতে পার, আমার আপত্তি নেই। শুধু যে বাধাটা আমি দিয়েছিলুম, সেইটেই আজ সরিয়ে দিলুম।
কিন্তু তার কারণ জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?
খেয়ালের কি কারণ থাকে যে, তুমি জিজ্ঞাসা করলেই আমাকে বলতে হবে!
মহিম ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া গম্ভীর হইয়া বলিল, কিন্তু সুরেশ, তোমার খেয়ালের বশেই যে সমস্ত সংসার বাধা পড়বে, আর উঠে যাবে, এ হলে হয়ত ভালই হয়; কিন্তু বাস্তব ব্যাপারে তা হয় না। তোমার যেখানে বাধা নেই, আমার সেখানে বাধা থাকতে পারে।
তার মানে?
তার মানে, তুমি সেদিন ব্রাহ্মমহিলাদের সম্বন্ধে যত কথা বলেছিলে, আমি তা ভেবে দেখেচি। ভাল কথা, সেদিন বলেছিলে, এক মাসের মধ্যে আমার জন্য পাত্রী স্থির করে দেবে, তার কি হল?
সুরেশ মুখ তুলিয়া দেখিল, মহিম গাম্ভীর্যের আড়ালে তীব্র পরিহাস করিতেছে। সেও গম্ভীর হইয়া জবাব দিল, আমি ত ভেবে দেখলুম মহিম, ঘটকালি করা আমার ব্যবসা নয়। তার পরে হাসিয়া কহিল, কিন্তু তামাশা থাক। এতদিন আমার মান রেখেচ বলে তোমাকে সহস্র ধন্যবাদ, কিন্তু আজ যখন আমার হুকুম পেলে, তখন কাল সকালেই একবার সেখানে যাচ্ছ ত?
না, কাল সকালে আমি বাড়ি যাচ্ছি।
কখন ফিরবে?
দশ-পনেরো দিনও হতে পারে, আবার মাস-খানেক দেরি হতেও পারে।
মাস-খানেক! না মহিম, সে হবে না। বলিয়া অকস্মাৎ সুরেশ ঝুঁকিয়া পড়িয়া মহিমের ডান হাতটা নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া কহিল, আর আমার অপরাধ বাড়িয়ো না মহিম, কাল সকালেই একবার যাও। তিনি হয়ত তোমার পথ চেয়ে বসে আছেন। বলিতেই তাহার কণ্ঠস্বর কাঁপিয়া গেল।
মহিমের বিস্ময়ের সীমা-পরিসীমা রহিল না। সুরেশের আকস্মিক আবেগকম্পিত কণ্ঠস্বর, এই সনির্বন্ধ অনুরোধ, বিশেষ করিয়া ব্রাহ্মমহিলা সম্বন্ধে এই সসম্ভ্রম উল্লেখে সে যেন বিহ্বল হইয়া গেল। কিছুক্ষণ বন্ধুর মুখের পানে একদৃষ্টে চাহিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কে আমার পথ চেয়ে বসে আছে সুরেশ? কেদারবাবুর মেয়ে?
সুরেশ সহসা আপনাকে সামলাইয়া লইয়া বলিল, থাকতেও ত পারেন?
মহিম আবার কিছুক্ষণ সুরেশের মুখের পানে চাহিয়া রহিল। সে যে ইতিমধ্যে ব্রাহ্মবাড়িতে গিয়া অনাহূত পরিচয় করিয়াও আসিতে পারে, এ সম্ভাবনা তাহার কোনমতেই মনে উদয় হইল না। খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, না সুরেশ, আমি হার মানছি—তোমার আজকের মেজাজ বাস্তবিক আমার বুদ্ধির অগম্য। ব্রাহ্মমেয়ে পথ চেয়ে বসে আছে, এ কথা তোমার মুখ থেকে বোঝা আমার দ্বারা অসম্ভব।
সুরেশ কহিল, আচ্ছা, সে কথা একদিন বুঝিয়ে দেব। তুমি বল, কাল সকালেই একবার দেখা দেবে?
না, কাল অসম্ভব। আমাকে সকালের গাড়িতেই যেতে হবে।
মিনিট-কয়েকের জন্যও কি দেখা দিতে পার না?
না, তাও পারিনে। কিন্তু তোমার কি হয়েছে বল দেখি?
সে কথা আর একদিন বলব—আজ নয়। আচ্ছা, আমি নিজে গিয়ে তোমার কথা বলে আসতে পারি কি?
মহিম অধিকতর আশ্চর্য হইয়া কহিল, পার, কিন্তু তার ত কিছু দরকার নেই।
সুরেশ কহিল, না থাক দরকার—দরকারই সব নয়। আমার পরিচয় দিলে তাঁরা চিনতে পারবেন?
একজন নিশ্চয়ই পারবেন।
সুরেশ বলিল, তা হলেই যথেষ্ট। তোমার বন্ধু বলে চিনবেন ত?