সুরেশ কহিল, আচ্ছা। তার পরে অচলার মুখের দিকে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, আমি একটা জিনিস বরাবর লক্ষ্য করেচি যে, মহিম কোন কারণেই এতটুকু ব্যথা না পায়, এই আপনার একমাত্র চেষ্টা। বেশ তাই হোক, আমি তাকে কোন কথাই বলব না। আজ তার সম্বন্ধে আমার মনে যত কথা উঠচে, তাও বলতে চাইনে, কিন্তু আপনাকে একটা কথা না বলে কিছুতেই বিদায় হতে পারচি নে।
অচলা স্নিগ্ধ চক্ষু-দুটি তুলিয়া কহিল, বেশ, বলুন।
সুরেশ কহিল, তার কাছে ক্ষমা চাইতে পেলুম না, কিন্তু আপনার কাছে চাইচি, আমায় মাপ করুন। বলিয়া সে হঠাৎ দুই হাত যুক্ত করিল।
ছি ছি, ও কি করেন! বলিয়া অচলা চক্ষের নিমিষে হাত-দুটি ধরিয়া ফেলিয়াই তৎক্ষণাৎ ছাড়িয়া দিয়া কহিল, এ কি বিষম অন্যায় বলুন ত! বলিতে বলিতেই তাহার সমস্ত মুখ লজ্জায় রাঙ্গা হইয়া উঠিল।
সুরেশের সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল। এই আশ্চর্য স্পর্শ, সলজ্জ মুখের অপরূপ রক্তিম দীপ্তি চক্ষের পলকে তাহাকে একেবারে অবশ করিয়া ফেলিল। সে অচলার অবনত মুখের পানে কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে চাহিয়া থাকিয়া অবশেষে ধীরে ধীরে কহিল, না, আমি কোন অন্যায় করিনি। বরঞ্চ আমার সহস্র-কোটি অন্যায়ের মধ্যে যদি কোন ঠিক কাজ হয়ে থাকে ত সে এই। আপনি ক্ষমা করলেই আমার মনের সমস্ত ক্ষোভ ধুয়ে মুছে যাবে।
অচলা কাতর হইয়া কহিল, আপনি অমন কথা কিছু বলবেন না। যাঁকে দু-দু’বার মৃত্যুর গ্রাস থেকে ফিরিয়ে এনেচেন—
তাও শুনেচেন?
শুনেচি। আপনার মত সুহৃৎ তাঁর আর কে আছে?
না, বোধ হয়, আপনি ছাড়া আর কেউ নেই। আর সেই সুবাদে আমরা দু’জন—
অচলার মুখের উপর আবার একটুখানি রাঙ্গা আভা দেখা দিল। সে কহিল, হাঁ, বন্ধু। আপনি তাঁকে মরণের পথ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন। তাই তাঁর সম্বন্ধে আপনার কোন কাজই আমি অন্যায় বলে ভাবতে পারিনে। মনের মধ্যে কোন ক্ষোভ, কোন লজ্জা আপনি রাখবেন না—ক্ষমা কথাটা উচ্চারণ করলে আপনার যদি তৃপ্তি হয়, আমি তাও বলতে রাজি ছিলুম, যদি না আমার মুখে বাধত।
আচ্ছা, কাজ নেই। বলিয়া সুরেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, আপনার বাবার সঙ্গে দেখা হল না, তিনি বোধ হয় ব্যস্ত আছেন। মহিমের সঙ্গে হয়ত আবার কোনদিন আসতেও পারি। নমস্কার।
অচলা একটুখানি হাসিয়া কহিল, নমস্কার। কিন্তু তাঁর সঙ্গেই যে আসতে হবে, এর ত কোন মানে নেই।
সত্যি বলচেন?
সত্যি বলচি।
আমার পরম সৌভাগ্য। বলিয়া সুরেশ আর একবার নমস্কার করিয়া বাহির হইয়া গেল।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
বাহিরে আসিয়া যেন নেশার মত তাহার সমস্ত দেহ-মন টলিতে লাগিল। আকাশের খর রৌদ্র তখন নিস্তেজ হইয়া পড়িতেছিল। সে গাড়ি ফিরাইয়া দিয়া একাকী পদব্রজে বাহির হইয়া পড়িল; ইচ্ছা, কলিকাতার জনাকীর্ণ কোলাহলময় রাজপথের মধ্যে আপনাকে সম্পূর্ণ মগ্ন করিয়া দিয়া অবস্থাটা একবার ভাবিয়া লয়।
অচলার মুখ, অবয়ব, ভাষা, ব্যবহার—সমস্তই তাহার শুরু হইতে শেষ পর্যন্ত পুনঃ পুনঃ মনে পড়িয়া নিজেকে যেন ছোট বলিয়া বোধ হইতে লাগিল।
সে মুখে সৌন্দর্যের অলৌকিকত্ব ছিল না, কথায়, ব্যবহারে, জ্ঞান, বিদ্যাবুদ্ধির অপরূপত্ব কোথাও এতটুকু প্রকাশ পায় নাই; তথাপি কেমন করিয়া যেন কেবলই মনে হইতে লাগিল, এমন একটা বিস্ময়কর বস্তু এইমাত্র সে দেখিয়া আসিয়াছে, যাহা এতদিন কোথাও তাহার চোখে পড়ে নাই। পথে চলিতে চলিতে আপনাকে আপনি অনুক্ষণ এই প্রশ্ন করিতে লাগিল—এ বিস্ময় কিসের জন্য? কিসে তাহাকে আজ এতখানি অভিভূত করিয়া দিয়াছে?
এই তরুণীর মধ্যে এমন কোন্ জিনিস আজ সে দেখিতে পাইয়াছে, যাহাতে আপনাকে আপনি লীন মনে করিয়াও তাহার সমস্ত অন্তরটা কি এক অপরিজ্ঞাত সার্থকতায় ভরিয়া গিয়াছে! ঐ মেয়েটির সত্যকার কোন পরিচয় এখনো তাহার ভাগ্যে ঘটে নাই বটে, কিন্তু সে যে বড়, অনেক বড় তাহাকে লাভ করা যে-কোন পুরুষের পক্ষেই যে দুর্ভাগ্য নয়, এ সংশয় একটিবারও তাহার মনে উদয় হয় না কেন? ভাবিতে ভাবিতে হঠাৎ এক সময়ে তাহার চিন্তার ধারা ঠিক জায়গাটিতে আঘাত করিয়া বসিল। তাহার মনে হইল, এই যে মেয়েটি শিক্ষায়, জ্ঞানে, বয়সে, হয়ত সকল বিষয়েই তাহার অপেক্ষা ছোট হইয়াও এই দণ্ড-কয়েকের আলাপেই তাহাকে এমন করিয়া পরাজিত করিয়া ফেলিল, সে শুধু তাহার অসাধারণ সংযমের বলে। তাই সে এত শান্ত হইয়াও এত দৃঢ়, এত জানিয়াও এমন নির্বাক। মহিমের সম্বন্ধে সে নিজে যখন প্রগল্ভের মত অবিশ্রাম বকিয়া গিয়াছে, তখন এই মেয়েটি অধোমুখে শুনিয়াছে, সহিয়াছে, কিন্তু মুহূর্তের জন্যও চঞ্চল হইয়া তর্ক করিয়া, কলহ করিয়া, আপনাকে লঘু করে নাই। সর্বক্ষণই আপনাকে দমন করিয়াছে, গোপন করিয়াছে, অথচ কিছুই তাহার অবিদিত ছিল না। মহিমকে সে যে কতখানি ভালবাসে, তাহা জানিতে দিল না সত্য, কিন্তু তাহার অবিচলিত শ্রদ্ধা যে কিছুতেই তিলার্ধ ক্ষুণ্ণ হয় নাই, সে কথা কতই না সহজে সংক্ষেপে জানাইয়া দিল।
এ বিদ্যা যে মহিমের কাছেই শেখা এবং ভাল করিয়াই শেখা, এ কথা সে বহুবার আপনাকে আপনি বলিতে লাগিল; এবং তাহার নিজের মধ্যে শিশুকাল হইতেই সংযম জিনিসটার একান্ত অভাব ছিল বলিয়া, ইহারই এতখানি প্রাচুর্য আর একজনের মধ্যে দেখিতে পাইয়া তাহার শিক্ষিত ভদ্র অন্তঃকরণ আপনা-আপনিই এই গৌরবময়ীর পদতলে মাথা নত করিয়া ধন্য বোধ করিল।