সুরেশ দৃপ্তস্বরে কহিল, যা নেই, তা আমি মানিনে। ভগবান নেই, ঠাকুর-দেবতা মিছে কথা। কিন্তু যা আছে, তাদের ত অস্বীকার করিনে। সমাজকে আমি শ্রদ্ধা করি, মানুষকে পূজা করি। আমি জানি, মানুষের সেবা করাই মনুষ্যজন্মের চরম সার্থকতা। যখন হিন্দুর বংশে জন্মেছি, তখন হিন্দুসমাজ রক্ষা করাই আমার কাজ। আমি প্রাণান্তে তোমাকে ব্রাহ্মঘরে বিবাহ করে ব্রাহ্মের দল-পুষ্টি করতে দেব না। কেদার মুখুয্যের মেয়েকে বিবাহ করবে বলে কি কথা দিয়েছ?
না, কথা যাকে বলে, তা এখনও দিইনি।
দাওনি ত! বেশ! তবে চুপ করে বসে থাক গে, আমি এই মাসের মধ্যেই তোমার বিবাহ দিয়ে দেব।
আমি বিবাহের জন্য পাগল হয়ে উঠেছি তোমায় কে বললে? তুমিও চুপ করে বসে থাক গে, আর কোথাও বিবাহ করা আমার পক্ষে অসম্ভব।
কেন অসম্ভব? কি করেছ? এই স্ত্রীলোকটাকে ভালবেসেছ?
আশ্চর্য নয়। কিন্তু এই ভদ্রমহিলার সম্বন্ধে সম্ভ্রমের সঙ্গে কথা বল সুরেশ।
সম্ভ্রমের সঙ্গে কথা বলতে আমি জানি, আমাকে শেখাতে হবে না। আমি সেই সম্ভ্রান্ত মহিলাটির বয়স কত জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?
জানি না।
জান না? কুড়ি, পঁচিশ, ত্রিশ, চল্লিশ কিংবা আরও বেশি—কিছুই জান না?
না।
তোমার চেয়ে ছোট, না বড়—তাও বোধ করি জান না?
না।
যখন তোমাকে ফাঁদে ফেলেছেন, তখন নিতান্ত কচি হবেন না—অনুমান করা বোধ করি অসঙ্গত নয়। কি বল?
না। তোমার পক্ষে কিছুই অসঙ্গত নয়। কিন্তু আমার এখন একটু কাজ আছে সুরেশ, একবার বাইরে যেতে চাই।
সুরেশ কহিল, বেশ ত মহিম, আমারও এখন কিছু কাজ নেই,—চল, তোমার সঙ্গে একটু ঘুরে আসি।
দুই বন্ধুই পথে বাহির হইয়া পড়িল। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া চলার পর সুরেশ ধীরে ধীরে কহিল, তোমাকে আজ যে ইচ্ছে করেই ব্যথা দিলাম, এ কথা বোধ করি বুঝিয়ে বলবার প্রয়োজন নেই?
মহিম কহিল, না।
সুরেশ তেমনি মৃদুকণ্ঠে প্রশ্ন করিল, কেন দিলাম মহিম?
মহিম হাসিল। কহিল, পূর্বেরটা যদি না বুঝালেও বুঝে থাকি, আশা করি, এটাও তোমাকে বুঝাতে হবে না।
তাহার একটা হাত সুরেশের হাতের মধ্যে ধরা ছিল। সুরেশ আর্দ্রচিত্তে তাহাতে ঈষৎ একটু চাপ দিয়া বলিল, না মহিম, তোমাকে বুঝাতে চাই না। সংসারে সবাই ভুল বুঝতে পারে, কিন্তু তুমি আমাকে ভুল বুঝবে না। তবুও আজ আমি তোমার মুখের উপরেই বলচি, তোমাকে আমি যত ভালবেসেছি, তুমি তার অর্ধেকও পারনি। তুমি গ্রাহ্য কর না বটে, কিন্তু তোমার এতটুকু ক্লেশও আমি কোনদিন সইতে পারি না। ছেলেবেলায় এই নিয়ে কত ঝগড়া হয়ে গেছে, একবার মনে করে দেখ। এখন এতকাল পরে যাঁর জন্য আমাকেও পরিত্যাগ করছ মহিম, তাঁকে নিয়েই জীবনে সুখী হবে যদি নিশ্চয় জানতাম, আমার সমস্ত দুঃখ আমি হাসিমুখে সহ্য করতে পারতাম, কখনও একটা কথা কইতাম না।
মহিম কহিল, তাঁকে নিয়ে সুখী না হতে পারি, কিন্তু তোমাকে ত্যাগ করব কেমন করে জানলে?
তুমি কর বা না কর, আমি তোমাকে ত্যাগ করব।
কেন? আমি ত তোমার ব্রাহ্মবন্ধু হতেও পারতাম!
না, কোনমতেই না। ব্রাহ্মদের আমি দু’চক্ষে দেখতে পারি না—আমার ব্রাহ্মবন্ধু একটিও নেই।
তাদের দেখতে পার না কেন?
অনেক কারণ আছে। একটা এই যে, যারা আমাদের সমাজকে মন্দ বলে ফেলে গেছে, তাদের ভাল বলে আমি কোনমতেই কাছে টানতে পারি না। তুমি ত জান, আমাদের সমাজের প্রতি আমার কত মমতা। সে সমাজকে যারা দেশের কাছে, বিদেশের কাছে, সকলের কাছে হেয় বলে প্রতিপন্ন করতে চায়, তাদের ভাল তাদের থাক, আমার তারা শত্রু।
মহিম মনে মনে অসহিষ্ণু হইয়া উঠিতেছিল; কহিল, এখন কি করতে বল তুমি?
সুরেশ কহিল, তাই ত এতক্ষণ ধরে ক্রমাগত বলচি।
আচ্ছা, আরও একবার বল।
এই যুবতীটির মোহ তোমাকে যেমন করে হোক কাটাতে হবে। অন্তত: একটা মাস দেখা করতে পারবে না।
কিন্তু তাতেও যদি না কাটে? যদি মোহের বড় আরও কিছু থাকে?
সুরেশ ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া কহিল, ও-সব আমি বুঝি না মহিম। আমি বুঝি, তোমাকে ভালবাসি; এবং আরও কত বেশি ভালবাসি আমার আপনার সমাজকে। তবে একটিবার ভেবে দেখ, তোমার ছেলেবেলার সেই বসন্তের কথাটা, আর মুঙ্গেরের গঙ্গায় নৌকা ডুবে যখন দুজনেই মরতে বসেছিলাম। বিস্মৃত কাহিনী স্মরণ করিয়ে দিলাম বলে আমাকে মাপ করো মহিম। আমার আর কিছু বলবার নেই, আমি চললাম। বলিয়া সুরেশ অকস্মাৎ দ্রুতবেগে পিছন ফিরিয়া চলিয়া গেল।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
সুরেশের একদিকে গায়ে জোর ছিল যেমন অসাধারণ, অন্যদিকে অন্তরটা ছিল তেমনি কোমল, তেমনি স্নেহশীল। পরিচিত—অপরিচিত কাহারও কোন দুঃখ-কষ্টের কথা শুনিলে তাহার কান্না আসিত। সে ছেলেবেলায় কখনো একটা মশামাছি পর্যন্ত মারিতে পারিত না। জৈন মারোয়াড়ীদের দেখাদেখি কতদিন সে পকেট ভরিয়া সুজি এবং চিনি লইয়া, স্কুল কামাই করিয়া, গাছতলায় গাছতলায় ঘুরিয়া পিপীলিকা ভোজন করাইয়াছে। জীবনে কতবার যে মাছ-মাংস ছাড়িয়াছে এবং ধরিয়াছে তাহার সংখ্যা নাই। যাহাকে ভালবাসিত, তাহার জন্য কি করিয়া যে কি করিবে, তাহা ভাবিয়া পাইত না। স্কুলে মহিম ছিল ক্লাসের মধ্যে সকলের চেয়ে ভাল ছেলে। অথচ তাহার গায়ের জামাকাপড় ছেঁড়াখোঁড়া, পায়ের জুতা জীর্ণ পুরাতন, দেহটি শীর্ণ, মুখখানি ম্লান—এই সব দেখিয়াই সে তাহার প্রতি প্রথমে আকৃষ্ট হইয়াছিল এবং অত্যল্পকালের মধ্যেই উভয়ের এই আকর্ষণ বন্যার জলের মত এমনি বাড়িয়া ওঠে যে, সমস্ত বিদ্যালয়ের ছেলেদের তাহা একটা আলোচনার বিষয় হইয়া পড়ে। মহিম ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় বৃত্তি পাইয়া, এই চারিটি টাকা মাত্র সম্বল করিয়া কলিকাতায় আসে এবং স্বগ্রামস্থ একজন মুদীর দোকানে থাকিয়া স্কুলে ভর্তি হয়। এই সময় হইতেই সুরেশ অনেকপ্রকারে বন্ধুকে নিজের বাটীতে আনিয়া রাখিবার চেষ্টা করে; কিছুতেই তাহাকে রাজি করাইতে পারে নাই। এইখানে থাকিয়াই মহিম কোনদিন আধপেটা খাইয়া, কোনদিন উপবাস করিয়া এন্ট্রান্স পাস করে। ইহার পরের ঘটনা পূর্ব-পরিচ্ছেদে বর্ণিত হইয়াছে।