চলুন, বলিয়া বৃদ্ধ স্বপ্নচালিতের ন্যায় অগ্রসর হইলেন। তাঁহার নিজের দুর্ঘটনার কাছে আর সমস্ত দুর্ঘটনাই একেবারে ছায়ার মত ম্লান হইয়া গিয়াছে— তাঁহার দুই কান জুড়িয়া কেবল বাজিতেছে— জাতি গেল, ধর্ম গেল, এই মানব— জন্মটাই যেন ব্যর্থ বৃথা হইয়া গেল।
সুরেশের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া যেমন তেমন করিয়া সমাধা করিতে অধিক সময় লাগিল না। সমস্তক্ষণ রামবাবু একটা কথাও কহিলেন না এবং ফিরিয়া আসিয়া সোজা এক্কা প্রস্তুত করিতে হুকুম দিলেন।
মহিম জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কি যাচ্চেন?
রামবাবু কহিলেন, হাঁ। আমাকে ভোরের ট্রেনে কাশী যেতে হবে, এখন না বেরোলে সময়ে পৌঁছুতে পারব না।
তাঁহার মনের ভাব মহিমের অবিদিত ছিল না এবং প্রায়শ্চিত্তের জন্যই যে তিনি কাশী ছুটিতেছেন, ইহাও সে বুঝিয়াছিল; তাই অতিশয় সঙ্কোচের সহিত কহিল, আমি বিদেশী লোক, এদিকের কিছুই জানিনে। দয়া করে যদি এঁর কোন যাবার ব্যবস্থা—, কথাটা শেষ হইতে পাইল না। অচলাকে সঙ্গে লইবার প্রস্তাবে বৃদ্ধ অগ্নির ন্যায় জ্বলিয়া উঠিলেন— দয়া! আপনি কি ক্ষেপে গেলেন মহিমবাবু?
মহিম এ প্রশ্নের প্রতিবাদ করিল না। সভয়ে, সবিনয়ে কহিল, বোধ হয় দু— তিন দিন ওঁর খাওয়া হয়নি। এই মৃত্যুপুরীর মধ্যে ভয়ানক অবস্থায় ফেলে যাওয়া—
তাহার এ কথাও শেষ করিবার সময় মিলিল না। আচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণের জন্মগত সংস্কার আঘাত খাইয়া প্রতিহিংসায় ক্রুর হইয়া উঠিয়াছিল; তাই তীব্র শ্লেষে বলিয়া উঠিলেন, ওঃ— আপনিও যে ব্রাহ্ম, সেটা ভুলে গিয়েছিলাম, কিন্তু মশাই, যত বড় ব্রহ্মজ্ঞানীই হোন, আমার সর্বনাশের পরিমাণ বুঝলে, এই কুলটার সম্বন্ধে দয়ামায়া মুখেও আনতেন না। বলিয়া গাড়িতে উঠিয়া বসিয়া কহিলেন, যাক, ব্রহ্মজ্ঞানে আর কাজ নেই— প্রাণ বাঁচাতে চান ত উঠে বসুন, জায়গা হবে।
মহিম নিঃশব্দে নমস্কার করিল। সর্বনাশের পরিমাণ লইয়াও দ্বন্দ্ব করিল না, প্রাণ বাঁচাইবার নিমন্ত্রণও গ্রহণ করিল না। তিনি চলিয়া গেলে শুধু বুক চিরিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস পড়িল মাত্র।
সর্বনাশের পরিমাণ! তাই বটে!
ভিতরে বসিয়া গাড়ির শব্দে অচলাও ইহা অনুভব করিল। কেন তিনি ভিতরে প্রবেশ করিলেন না, একটা কথা পর্যন্ত বলিয়া গেলেন না, তাহাও অত্যন্ত সুস্পষ্ট।
এতক্ষণ সুরেশের অনিবার্য মৃত্যু যে ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তার উপলক্ষ সৃষ্টি করিয়া একটা অন্তরাল রচিয়াছিল, তাহাও নাই; এইবার মহিম অত্যন্ত সম্মুখে, অত্যন্ত কাছাকাছি আসিয়া দাঁড়াইবে, কিন্তু আর তাহার মন কিছুতেই সাড়া দিতে চাহিল না। নিজের জন্য লজ্জা বোধ করিতেও সে যেন ক্লান্তিতে ভরিয়া উঠিল।
মহিম আসিয়া দেখিল, সে কেরোসিনের আলোটা সম্মুখে রাখিয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছে। কহিল, এখন তুমি কি করবে?
আমি? বলিয়া অচলা তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া কত কি যেন ভাবিতে লাগিল; শেষে বলিল, আমি ত ভেবে পাইনে। তুমি যা হুকুম করবে, আমি তাই করব।
এই অপ্রত্যাশিত বাক্য ও ব্যবহারে মহিম বিস্মিত হইল, শঙ্কিত হইল। এমন করিয়া সে একবারও চাহে নাই। এ দৃষ্টি যেমন সোজা, তেমনি স্বচ্ছ। ইহার ভিতর দিয়া তাহার বুকের অনেকখানি যেন বড় স্পষ্ট দেখা গেল। সেখানে ভয় নাই, ভাবনা নাই, কামনা নাই, কল্পনা নাই — যতদূর দেখা যায়, ভবিষ্যতের আকাশ ধুধু করিতেছে। তাহার রঙ নাই, মূর্তি নাই, গতি নাই, প্রকৃতি নাই— একেবারে নির্বিকার, একেবারে একান্ত শূন্য।
উপদ্রুত, অপমানিত, ক্ষতবিক্ষত নারী— হৃদয়ের এই চরম বৈরাগ্যকে সে চিনিতে পারিল না। একের অভাব অপরের হৃদয়কে এমন নিঃস্ব করিয়াছে কল্পনা করিয়া তাহার সমস্ত মন তিক্ততায় পূর্ণ হইয়া গেল। কিন্তু নিজের দুঃখ দিয়া জগতের দুঃখের ভার সে কোনদিন বাড়াইতে চাহে না, তাই আপনাকে আপনার মধ্যে ধরিয়া রাখাই তাহার চিরদিনের অভ্যাস। পাছে এই বক্ষভরা তিক্ততা তাহার কণ্ঠস্বরে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে, এই ভয়ে সে অন্যত্র চক্ষু ফিরাইয়া লইয়া কিছুক্ষণ মৌন হইয়া রহিল; তার পরে সহজ গলায় বলিল, আমি কেন তোমাকে হুকুম দেব অচলা, আর তুমিই বা তা শুনতে বাধ্য হবে কিসের জন্য?
কিন্তু তুমি ছাড়া আর যে কেউ নাই, কেউ ত আমার সঙ্গে আর কথা কবে না! বলিয়া অচলা তেমনি একইভাবেই মহিমের মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল।
মহিম কহিল, এই কি আমার কাছ তুমি প্রত্যাশা কর?
বোধ হয় প্রশ্নটা অচলার কানেই গেল না। সে নিজের কথার রেশ ধরিয়া যেন আপনাকে আপনিই বলিতে লাগিল, তোমাকে হারিয়ে পর্যন্ত ভগবানকে আমি কত জানাচ্চি, হে ঈশ্বর! আমি আর পারিনে— আমাকে তুমি নাও! কিন্তু তিনিও শুনলেন না, তুমিও শুনতে চাও না। আমি আর কি করব!
মহিম কোন জবাব না দিয়া বাহিরে চলিয়া গেল, কিন্তু এই নৈরাশ্যের কণ্ঠস্বর, এই নিরভিমান, নিঃসঙ্কোচ, নির্লজ্জ উক্তি আবার তাহার চিত্তকে দ্বিধাগ্রস্ত করিয়া তুলিল। এই সুর কানের মধ্যে লইয়া সে বাহিরে প্রাঙ্গণে বেড়াইতে বেড়াইতে ইহাই ভাবিতে লাগিল, কি করা যায়! আপনার ভারে সে আপনি ভারাক্রান্ত, আবার তাহারি মাথায় সুরেশ যে তাহার সুকৃতি ও দুষ্কৃতির গুরুভার চাপাইয়া এইমাত্র কোথায় সরিয়া গেল, এ বোঝাই বা সে কোথায় গিয়া কি করিয়া নামাইবে?
রঘুবীর অনেক পরিশ্রমে খবর লইয়া আসিল যে, ডিহরীর পথে ক্রোশ— তিনেক দূরে কাল সকালেই একটা হাট বসিবে, চেষ্টা করিলে সেখানে গো— শকট পাওয়া যাইতে পারে।