এক্ষণে কিরূপে তাহার হৃদয়-আকাশের শরচ্ছন্দ্রমা, জীবন-উদ্যানের রসালবৃক্ষ আফজাল খাঁকে হত্যাকান্ড হইতে রক্ষা করিবে, তচ্ছিন্তায় শিবাজী-নন্দিনী যৎপরোনাস্তি আকুল হইয়া উঠিল। নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়াও তাহার আকাঙ্খিত প্রেম-দেবতা আফজাল খাঁকে দস্যুধর্মী পিতার নিদারুণ ষড়যন্ত্র এবং নৃশংস হত্যাকান্ড বাঁচাইবার জন্য তারাবাঈ ব্যস্ত হইয়া উঠিল।
মানব-হৃদয়ে যখন নবীন প্রেমের সঞ্চার হয়, তখন উহা গিরিগুহা-নির্গত তরঙ্গিণীয় ন্যায় তীব্রবেগে প্রবাহিত হয়। বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করিয়া ছুটিতে থাকে। নদীর সম্বন্ধে-
“পর্বত-গৃহ ছাড়ি,
বাহিরায় যবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশে
কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি?”
ইহা যেমন সত্য, প্রেমের সম্বন্ধেও তেমনি নীচের কবিতাটি অটুট সত্য।
মানস কন্দর হ’তে যৌবন-ঊষায়,
যে প্রেমের মন্দাকিনী কারো পানে ধায়,
কার সাধ্য তার গতি করে অবরোধ?
রোধিতে যে চায়, সেই নিতান্ত নির্বোধ!
বায়ু জল উল্কা তীর কত ধরে বেগ
তাহার অধিক জান প্রেমের উদ্বেগ!
প্রেমের সমুখে হায়! কঠিন পাষাণ
হ’য়ে যায় সুকোমল ফুলের সমান!
সাগর গোস্পদ হয়, মরু হয় বন,
দুঃখে উপজয় সুখ, মরণে জীবন!
যত দুঃখ যত কেশ যত নির্যাতন,
প্রেম করে সকলেরে সুধা-প্রস্রবণ!
বিষেরে অমৃত করে, আঁধারে আলোক,
নরকেরে স্বর্গ করে বিষাদে পুলক,
আপনারে ভুলে যাওয়া পরের কারণ
ইহাই প্রেমের বটে প্রথম লণ।
দ্বিতীয় লণ শুধু স্মরণ, সেবন
প্রেমাস্পদ হেতু শেষে আনন্দে মরণ!
তারাবাঈ নিঃশব্দ পদ-সঞ্চারে প্রাচীরের গায়ে কান লাগাইয়া রুদ্ধ নিঃশ্বাসে শিবাজীর সমস্ত পরামর্শ শ্রবণ করিল। আফজাল খাঁকে হত্যা করিবার জন্য ষড়যন্ত্রের সমস্ত মন্ত্রণা শুনিয়া ব্যাকুল চিত্তে চরণে তথা হইতে প্রস্থান করিল।
তারাবাঈ ০৭ পরিচ্ছেদ
তরুণ অরুণের কনক-কিরণ-রাগে চতুর্দিকে আলোকিত হইয়াছে। প্রভাত-পবন-বনভূমির স্বভাবজাত কুসুমগন্ধ বহন করিয়া মৃদুমন্দ সঞ্চরণ করিতেছে। শিশির-সিক্ত পাতায় পাতায় সূর্যের রশ্মি পতিত হইয়া শ্যামলিমার অঙ্গে লালিমার কি অপূর্ব বাহার খুলিয়াছে! নানাজাতীয় বিচিত্র-বর্ণ-বিচিত্র-পক্ষ সুধাকণ্ঠ বিহঙ্গগণ কুজন-লহরীতে বিশাল আরণ্য প্রকৃতিকে মুখরিত এবং পুলকিত করিয়া তুলিয়াছে! এমন সময়ে কৃষ্ণগড় ও রায়গড়ের সীমানাস্থিত অরণ্যে মৃগয়ার জন্য শিবাজী এবং আফজাল খাঁ কতিপয় শিকারী অনুচর, বহুসংখ্যক কুক্কর, বাজপী ও পালিত চিতা বাঘ সহ প্রবেশ করিলেন। পঞ্চাশটি হস্তী শিকারী ও শিকারের সরঞ্জাম বহন করিয়া নিবিড় অরণ্য তোলপাড় করিয়া ক্রমশঃ গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করিল। হস্তিযুগল ভয়ে বিহঙ্গগণ ত্রাসিত হইয়া চতুর্দিকে ছত্রভঙ্গ অবস্থায় উড়িতে লাগিল। মৃগ, কৃষ্ণসার ও অন্যান্য আরণ্যজন্ত চতুর্দিকে ভয়ে ছুটিয়া পলায়ন করিতে লাগিল। শিকারীগণ কেহ তীর, কে বা বন্দুকের দ্বারা মৃগ শিকার করিতে লাগিল।
শিকার করিতে করিতে ক্রমশঃ আফজাল খাঁ এবং শিবাজী একটি ক্ষুদ্র পাবর্ত-নদীর তটে গভীর বনে উপস্থি হইলেন। এই নিবিড় বনের একটানা শ্যামল-শোভা-দেখিয়া আফজাল খাঁ নিতান্তই বিমোহিত হইলেন। এই বনে সিংহ বাস করিত বলিয়া সাধারণ শিকারীরা প্রায় এ-দিকে পদাপর্ণ করিত না। কিন্তু আফজাল খাঁর সিংহ এবং ব্যাঘ্র শিকারের অপরিমিত কৌতূহল ছিল বলিয়া এই বনে স্বেচ্ছায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বনের নিবিড় প্রদেশে উপস্থিত হইয়া আফজাল খাঁ দুই হস্তে বক্রমুখ ক্ষুদ্রাকৃতি দুইখানি তরবারি ধারণপূর্বক হস্তিপৃষ্ঠ হইতে অবতরণপূর্বক দুইজন অনুচর সহ পদব্রজে বনের ভিতরে প্রবেশ করিলেন। এই সিংহ-নিবাস বনে প্রবেশ করিতে অনেকেরই অমত ছিল। কিন্তু পাঠান বীর আফজাল খাঁর জ্বলন্ত উৎসাহ এবং দৃঢ়তার নিকট সকলের আপত্তি ও ভীতি প্লাবনের মুখে তৃণগুচ্ছের ন্যায় ভাসিয়া গেল। আফজাল খাঁর পশ্চাতে আরও পাঁচজন বীরপুরুষ তরবারি মাত্র হস্তে ধারণ করিয়া সেই শ্বাপদ-সঙ্কুল ভয়াবহ বনে প্রবেশ করিলেন। শিবাজী এবং তাঁহার অন্যান্য মারাঠা অনুচর এবং আফজাল খাঁর সঙ্গীয় অন্যান্য যোদ্ধা ও শিকারী হস্তিপৃষ্ঠে সেই নিবিড় বনের মধ্যে খাঁ সাহেবের পশ্চাৎ পশ্চাৎ প্রবেশ করিল।
বনের মধ্যে প্রবেশ করিয়া সকলেই প্রকান্ড শাল, গজারী, দেবদারু, তমাল, তাল প্রভৃতি বৃক্ষ দর্শনে স্তম্ভিত হইলেন। বহুকালের বৃক্ষরাজিতে পরিপূর্ণ হইয়া এই নিবিড় বন যার-পর-নাই গম্ভীর দৃশ ধারণ করিয়াছিল। এই কারণে সূর্যরশ্মি কদাচিৎ প্রবেশ করিত। আফজাল খাঁ অনুচর পঞ্চকসহ সেই নিবিড় বনে সিংহ শিকারের জন্য তরবারি হস্তে ক্রমশঃ ধীরে ধীরে জঙ্গল ভাঙ্গিয়া অগ্রসর হইতে লাগিলেন। অগ্রসর হইতে হইতে এক ক্ষুদ্র পবর্তমূলে একটি গুহার সম্মুখীন হওয়া মাত্র সহসা দুইটি সিংহ ভীষণ গর্জনে অরণ্যভূমি প্রকম্পিত করিয়া উল্লস্ফপূর্বক আফজাল খাঁর উপর পতিত হইবার উপক্রম করিল। তখন মহাবীর আফজাল খাঁ এবং সহচরগণ মুহুর্ত মধ্যে সাবধান হইয়া দৃঢ়মুষ্টিতে সিংহ লক্ষ্যে তরবারি ধারণ করিলেন। এই সময় বীরবর আফজাল খাঁ এবং তাঁহার সঙ্গীদের বদনে অপূর্ব দৃঢ়তা এবং বীরত্বের তেজঃ অতি চমৎকাররূপে ফুটিয়া উঠিল। সিংহ আফজাল খাঁর উপরে পতিত হইবার প্রাক্কালে মহাসাহসী আফজাল খাঁ তরবারির প্রচন্ড আঘাতে সিংহের গ্রীবাচ্ছেদন করিয়া লস্ফ প্রদানপূর্বক দূরে সরিয়া দাঁড়াইলেন। সিংহিনীও আফজাল খাঁ সরিয়া যাওয়ার তাঁহার উপরে আপতিত হইতে না পারিয়া মুহুর্তের জন্য স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইল এবং পর মুহুর্তেই লম্ফ প্রদানপূর্বক বিদ্যুদ্বেগে আফজাল খাঁর বাম বাহুর উপরে পতিত হওয়া মাত্রই খাঁ সাহেব দক্ষিণ হস্তের অসির ভীষণ আঘাতে সিংহিনীর মস্তক বিদ্ধ করিয়া ফেলিলেন।