মাঃ নিশ্চয়ই। এরূপ ভন্ডামী এবং এরূপ শয়তানী নিশ্চয়ই নিতান্ত বিরল!
রোঃ ভন্ডামী কিরূপ? হায়! একেই বলে ‘যার কি চুরি সেই বলে চোর!’
মাঃ ভন্ডামী না হয়ত, ষন্ডামী ত বটেই। সাত সাতটি স্ত্রী এবং কয়েক গন্ডা উপপত্নী থাকলেও যাঁর আমার জন্য ঘুম হয় না, সে যদি আদর্শ প্রেমিক হয়, তবে আদর্শ লম্পট এবং পিশাচ আর কে?
রোঃ যে ব্যক্তি যাকে তনুমন সমর্পণ করেছে, সে যদি তা’কে না পায়, তা’ হলে তার ঘুম না হওয়াই ত স্বাভাবিক। এ অবস্থায় ত বেচারা শিবাজীর প্রতি দয়া হওয়াই স্বাভাবিক।
মাঃ বটে, বলিস কি? তুই পাগল নাকি! এরূপ লোকের প্রতি যদি দয়া হয়, তা’ হলে, বাম পদাঘাত করবার প্রবৃত্তি হবে আর কা’কে?
রোঃ ছিঃ! ছিঃ! এমন কথা বলা কি সঙ্গত?
মাঃ যে ব্যক্তি নারী লাভের জন্য পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করতে প্রস্তুত তা’র প্রতি ইহা অপেক্ষা সদুক্তি আর কি হ’তে পারে? যদি শিবাজী আজ ধর্মের জন্যই ধর্ম পরিগ্রহ করতেন, তা’ হলে নিশ্চয়ই মুক্তকণ্ঠে তাঁর প্রশংসা কীর্তন করতাম। শিবাজী ইসলাম ধর্ম পরিগ্রহ করলেও কদাপি তাতে স্থিরতর থাকবেন না। কোনও রূপে আমার রাজ্য এবং আমাকে হস্তগত করবার জন্যই ইসলাম গ্রহণের ভাণ করা হচ্ছে। শিবাজী ইসলামের পরম শক্রু। তিনি মসজিদগুলি চূর্ণ এবং তাহা শূকর-রক্তে অপবিত্র ক’রে পরম আনন্দ লাভ করছেন। শিবাজীর ন্যায় নৃশংস দস্যু যদি দমিত না হয়, তা’ হলে ইসলামের সমূহ অমঙ্গল বুঝতে হবে। আমি এহেন অস্পৃশ্য পাষন্ড কাফেরের পাণিগ্রহণ করব, এরূপ আশা করা বাতুলের পক্ষেই শোভা পায়। বরং শিবাজী এবিষয়ে যতই চেষ্টা করবেন, আমার ঘৃণা ও অশ্রদ্ধা ততই বৃদ্ধি পাবে। আমি প্রাণান্তেও এমন ঘৃণিত দস্যু ও জাহান্নামী কাফেরকে কিছুতেই স্বামীত্বে বরণ করতে স্বীকৃত নহি। এমনকি, এ বিষয়ের আলোচনা করতেও আমি ঘৃণা এবং বিরক্তি বোধ ক’রে থাকি।
তারাবাঈ ০৪ পরিচ্ছেদ
ঊষা তাহার অরুণিমা-জালের চাঁপা আঙ্গুলের কোমল স্পর্শে ঘন আঁধাররাশিকে তরল করিয়া নিদ্রিত বিশ্ববক্ষে নব চেতনার সঞ্চার করিতেছে। প্রভাতবায়ু কুসুম-গন্ধ হরণ করিয়া মৃদুমন্দ গতিতে স্বাস্থ্য ও স্নিগ্ধতা বিতরণ করিয়া প্রবাহিত হইতেছে। মধুরকণ্ঠে নানা ছন্দে সুললিত তানে বিশ্বপিতার মহিমা কীর্তন করিতেছে। ধীরে ধীরে মৃতবৎ জগৎবক্ষে কেন মনোহর ও মধুরভাবে নবজীবনে আবির্ভাব সূচিত হইতেছে।
এ হেন মধুর প্রভাতকালে অতি প্রত্যুষেই রায়গড়ের রাজপথের পার্শ্বে লোক সমাগম পরিদৃষ্ট হইতেছে। আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি, রায়গড় তখন অতি ক্ষুদ্র শহর।
এই ক্ষুদ্র শহর আজ বিজাপুরের সেনাপতি মহাবীর আফজাল খাঁর অভ্যর্থনাহেতু পরম রমণীয়ভাবে সজ্জিত হইয়াছে। পথের মধ্যে মধ্যে নানাস্থানে বিচিত্র তোরণসমূহ নির্মিত হইয়াছে! পতাকা, পুস্প এবং কদলী বৃক্ষে সমস্ত রাস্তা গোলজার করা হইয়াছে। মহারাষ্ট্রগণ যথাসম্ভব উৎকৃষ্ট বেশ-ভূষার সজ্জিত হইয়া সোৎসুকচিত্তে অপেক্ষা করিতেছে! মহারাষ্ট্র রমণীগণ পুস্পগুচ্ছে কুন্তল সাজাইয়া বিচিত্র ভঙ্গীতে কোঁচা ও কাছা দিয়া শাটী পরিয়া অট্টহ্স্যে এবং কোলাহলের গগণ-পবন মুখরিত করিয়া রাস্তার এক এক স্থানে জটলা পাকাইতেছে। বহু সংখ্যক বালক ইতস্ততঃ ছুটাছুটি করিতেছে।
এদিকে বাদ্যোদ্যমসহ মহারাষ্ট্রদিগের রাজা শিবাজী সহস্র সংখ্যক অশ্বারোহী সৈন্যসহ মুসলমান-পোষাকে উৎকৃষ্টরূপে সজ্জিত হইয়া সপারিষদ আসিয়া নগর তোরণের মূলে শ্রেণীবন্ধভাবে দন্ডায়মান হইলেন।
সহসা দূরে একটি তোপ গর্জন করিয়া উঠিল। সেই তোন গর্জনের সঙ্গেই সর্বত্র একটি অস্ফুট কলরব উত্থিত হইল। শিবাজী অশ্বারোহী সৈন্য এবং পারিষদগণকে সঙ্গে লইয়া বেগে অশ্ব ছুটাইলেন। নহবতে নহবতে শাহানার সুরে শানাই বাজিয়া উঠিল। রাস্তার পার্শ্বেই বাটী হইতে শঙ্খধ্বনি হইতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে শিবাজী, বিজাপুরের সেনাপতি বীরবর আফজাল খাঁকে পরম সমাদরে এবং বিপুল আড়ম্বরে অভ্যর্থনা করিয়া রাজপ্রসাদের দিকে অগ্রসর হইলেন। শিবাজীর সৈন্যগণ পতাকা উড়াইয়া এবং বিগল বাজাইয়া অগ্রে অগ্রে গমন করিতে লাগিলেন। পশ্চাতে আফজাল খাঁ সহস্র সংখ্যক বীর পুরুষগণ বিপুল উৎসাহে নানাবিধ শ্রুতিমধুর বাদ্য বাজাইতে বাজাইতে অগ্রসর হইল। তৎপশ্চাতে বিপুল জনতা ও পদাতিক সৈন্যগণ চলিতে লাগিল। মারাঠা রমণীরা চতুর্দিক হইতে হুলুধ্বনি দিতে লাগিল।
আকাশে সূর্য উঠিয়াছে! তরুণ অরুণের লোহিত কিরণরাগে গগণ-ভুবন মনোমোহন সৌন্দর্যে ভূষিত হইতেছে। কিন্তু বিশ্বলোচন সবিতা-দেবের প্রতি আজ কাহারো দৃষ্টি নাই। যে সমস্ত হিন্দু সূর্যোদয় “জবা কুসুম সঙ্কাশ” প্রভৃতি স্তব আওড়াইয়া প্রত্যহ সূর্যের উপাসনা করিত, তাহাদেরও আজ সেই উপাস্য সূর্য-দেবতার দিকে নজর নাই। আজ সকলের দৃষ্টিই বিজাপুরের বীর সেনানী রূপবান ও তেজীয়ান আফজাল খাঁর প্রতি! আফজাল খাঁ অশ্বারোহণে চলিয়াছেন! তেজীয়ান অশ্ব নৃত্যশীল গতিতে ধীরে ধীরে কি বাঁকা ভঙ্গিমাতেই চলিয়াছে! আফজাল খাঁ রূপের ছটায় এবং বীর্যগরিমায় চারিদিক যেন আলো করিয়া চলিয়াছেন। কিবা কমনীয় কান্তি! কিবা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিব্যঞ্জন আয়ত লোচনযুগন! কিবা অঙ্কিত ভ্র! কিবা প্রশস্ত ললাট! কেমন বলিষ্ঠ ও পুষ্ট দেহ! মরি! মরি! কি তেজঃপুঞ্জ মূর্তি! কি বীরত্বব্যঞ্জক গোঁফ। যে দেখিল, সেই মুগ্ধ হইল। রমণীমহলে এই অপরূপ রূপের অস্ফুট স্বরে সমালোচনা উঠিল। সকলেই আফজাল খাঁর কোনও-না-কোনও অঙ্গের প্রশংসা করিতে লাগিল! তাঁহার সঙ্গীয় অশ্বারোহী সৈন্য এবং দেহরগিণেরই বা কি মনোরম গঠন-পারিপাট্য! কি বাঁকা ঠাম?