তাহার মাতামহ মলহর রাও নানাস্থানে নানাদিকে অনুসন্ধানী লোক পাঠাইলেন। নানুপুরে মালোজীর নিকট একজন অশ্বারোহীকে অবিলম্বেই পাঠান হইল। মালোজী তখন বিশেষ কার্যের জন্য নানুপুরে অবস্থিতি করিতেছিলেন।
সংবাদ শুনিয়া মালোজী বজ্রাহতের ন্যায় প্রথম স্তম্ভিত হইলে, কিন্তু পর মূহুর্তের পনর জন্য অশ্বারোহী সহ তুঙ্গা নদীর তীর ধরিয়া দুই পর্বতের মধ্যবর্তী ভবানীপুর নামক স্থানে-যেখানে নদী সঙ্কীর্ণ অথচ গভীর প্রবাহে প্রবাহিত হইতেছে, সেই ভবানীপুর লক্ষ্য করিয়া বিদ্যুদ্বেগে ঘোড়া ছুটাইলেন। ঘোড়াগুলি পদাঘাতে প্রস্তর-গাত্রে স্ফুলিঙ্গ ছুটাইয়া এবং পর্বত ও বন-প্রান্তরে পদধ্বনির প্রতিধ্বনি তুলিয়া তীব্রবেগে ছুটিয়া চলিল। তরুশাখাসীন বিহঙ্গাবলী এবং ক্ষেত্রমধ্যস্থ বাবুই পক্ষীর ঝাঁক কেবল চকিতে চঞ্চল হইয়া কোলাহল করিতে করিতে উড়িয়া চলিল। পথিকগণের চক্ষে কেবল মারাঠী সৈন্যদিগের রবিকর-প্রতিফলিত বর্শাফলকগুলি ঝলিতে লাগিল।
তারাবাঈ ১৭ পরিচ্ছেদ
নৌকা চলিয়াছে। একটু বাতাস বহিতেই মাঝি আবার নৌকায় পাল তুলিয়া দিল। সকলেই নিরুদ্বেগচিত্তে নানা প্রকার গালগল্পে মশগুল! ভবানীপুর আর বেশী দূর নহে। ভবানীপুর পার হইলেই নৌকা প্রশস্ত নদীবক্ষে পড়িবে।
মালেকা বলিলেন, “যে-পর্যন্ত ভবানীপুর না ছাড়াও, সে-পর্যন্ত বিশেষ সাবধানে চলবে।” মালেকা নিজে নৌকার ছইয়ের উপর বসিয়া নদীর দক্ষিণ পার্শ্বের যেখানে সেখানে বন ছিল, সেখানে সেখানে নিপুণ দৃষ্টিতে দেখিয়া যাইতে লাগিলেন। ক্রমশঃ সন্ধ্যার প্রাক্কালে নৌকা ভবানীপুরের নিকটবর্তী হইল। নৌকা ভবানীপুর পার হইয়াছে, এমন সময় কতিপয় অশ্বারোহী মারাঠী চীৎকার করিয়া নৌকা থামাইতে বলিল। মালেকার বুঝিতে বাকি রহিল না, ইহারা শত্রু পক্ষেরই লোক। সুতরাং মাঝিকে অপর তীরে নৌকা চালাইতে ইঙ্গিত করিল। নৌকা নদীর অত্যন্ত প্রশস্থ স্থানে আসিয়া পড়িয়াছে। এ অবস্থায় দস্যুদের পক্ষে নৌকা আক্রমণ করা সহজ নহে! নৌকা অপর তীরে দূর দিয়া চলিয়া যাইতেছে দেখিয়া মারাঠীরা ভীষণ চীৎকার করিতে লাগিল। তাহার চীৎকার করিয়া বলিল, “আমরা দস্যু নহি। আমরা কোতয়ালীর লোক। তোমরা কোনও রমণীকে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছ কি-না, তা’ই মাত্র আমাদের প্রতি দেখবার হুকুম। আমরা তোমাদের কোনও অনিষ্ট করব না। অল্পক্ষণের জন্য তোমাদের নৌকা থামাও, নতুবা আমরা গুলী চালাব। অনর্থক খুন-জখম হবে।”
মালেকার ইঙ্গিতে মাঝি বলিল, “আচ্ছা, তবে আমরা সম্মুখের বাঁকে থামাচ্ছি। তোমরা অনুসন্ধান করে দেখ।” বাতাস খুব জোরে বহিতেছিল, সুতরাং অল্প সময়ের মধ্যে নৌকা বাঁকে আসিয়া লাগিল। নদীব তখন অন্ধকার আচ্ছন্ন। তবে নির্মেঘ আকাশ বলিয়া দৃষ্টি একেবারে অবরুদ্ধ নহে। মালেকার নৌকার ভিতরে মাত্র একটি ক্ষীণ বাতি মিটিমিটি করিয়া জ্বলিতেছিল। বাহিরে তাহার আলোক প্রায় কিছুই দেখা যাইতেছিল না।
মালেকা সকলকে যাহার যাহা কর্তব্য বেশ করিয়া বুঝাইয়া দিলেন। নৌকার ভিতরে অব্যর্থ-লক্ষ্যে সৈনিকগণ নৌকার পার্শ্বের ছইয়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্রের মুখে বন্দুকের নল সংযোগ করিয়া হাঁটু গাড়িয়া বসিল। দ্বাদশ ছিদ্রে দ্বাদশটি বন্দুক সংস্থাপিত হইল। আট জন মাল্লা এবং এক জন মাঝি মাত্র বাহিরে রহিল। তাহারা সকলেই আপন আপন কার্য সম্পাদনে অত্যন্ত পটু।
দস্যুরা দুইটি প্রকান্ড মশাল জ্বালাইয়া নদীর তীরে সারিবন্দী অবস্থায় দন্ডায়মান রহিল।
মাঝি বিনীতভাবে মালোজীকে বলিল, “সর্দার সাহেব! আপনি যে কয় জন ইচ্ছা লোক লইয়া নৌকার ভিতরে এসে দেখে যান। তবে ভিতরে এরূপ স্থানাভাব যে, ৩/৪ জনের অধিক লোকের দাঁড়াবার জায়গা হবে না। জিনিসপত্রে বোঝাই হয়ে রয়েছে।”
মালোজীঃ বেশি লোক নিয়ে দরকার কি? আমি মাত্র দু’জন লোক নিয়ে উঠেছি। তোমাদিগকে মিছামিছি জ্বালাতন করব না।-এই বলিয়া মালোজী তরবারিধারী দুইজন সৈনিকপুরুষ সহ নৌকার সিঁড়িতে পদার্পণ করিলেন। মাল্লারা কয়েকজন আসিয়া মস্তক নত করিয়া বিশেষ শ্রদ্ধাভরে সালাম করিল। মালোজী সৈনিক পুরুষদ্বয় সহ নৌকায় যেমনি উঠা, অমনি তাহাদের ঘাড়ে বজ্রের ন্যায় ভীষণ মুষ্ট্যাঘাত আর সেই সঙ্গে একেবারে দ্বাদশ বন্দুকের এক সঙ্গে আওয়াজ। দ্বাদশটি অশ্বারোহী সৈন্য মুহুর্ত মধ্যে অশ্বপৃষ্ঠ হইতে ভূপতিত হইল। ঘোড়াগুলি ভড়কাইয়া দিদ্বিদিকে উধাও হইয়া পলায়ন করিল। অবশিষ্ট তিনজন অশ্বারোহী প্রাণভয়ে চীৎকার করিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়মান হইবার উপক্রমেই মাল্লাদিগের গুলীর আঘাতে হতজীবন হইয়া ভূপতিত হইল।
এদিকে নৌকায় সমাগত মালোজী, সঙ্গীদ্বয়সহ মুহুর্ত মধ্যে বন্দী হইয়া পড়িলেন। অস্ত্র-শস্ত্র কাড়িয়া লইয়া লৌহশৃঙ্খলে কঠোরভাবে আবদ্ধ করিয়া তিন জনকে নৌকার ডহরে রজ্জুবদ্ধ কুর্মের ন্যায় ফেলিয়া রাখা হইল।
এদিকে তিন চার জন্য মাল্লা তীরে উঠিয়া নিহত মারাঠীদিগের অস্ত্র-শস্ত্রগুলি নৌকায় উঠাইয়া তাহাদের লাশগুলি নদীতে ফেলিয়া দিয়া তাড়াতাড়ি নৌকা ছাড়িয়া দিল।
প্রবল পবনে তখন নৌকা বিজয়ী বীরের মত স্ফীত বক্ষে ছুটিতে লাগিল। এই ঘটনার বর্ণনা করিতে যে-সময় লাগিল, তাহার দশমাংশ সময়ের মধ্যে সমস্ত কার্য সম্পন্ন হইয়া গেল। অতঃপর সকলে করুণাময় খোদাতা’লাকে প্রাণ খুলিয়া ধন্যবাদ দিল।
তারাবাঈ ১৮ পরিচ্ছেদ
চৈত্র মাসের শেষ। বসন্তের পূর্ণ বিকাশ এবং গ্রীস্মের সমাগমে শিবাজী ক্রমশঃ পরাস্ত হইয়া নিবিড় কাননে আশ্রয় গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছেন। তাঁহার সৈন্যদল ছিন্নভিন্ন হইয়া ঝাড়ে জঙ্গলে এবং পাহাড়-পর্বতে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে। মালোজী বন্দী হওয়ায় শিবাজী যার-পর-নাই হতাশ এবং বিমূঢ় হইয়া পড়িলেন। রামদাস স্বামী, আবাজী প্রভৃতি তখন সন্ধি করিবার জন্য শিবাজীকে বিশেষভাবে উপদেশ দিতে লাগিলেন। কিন্তু আফজাল খাঁ শিবাজীকে সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত করিয়া সন্ধি করিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। সন্ধির জন্য পুনঃ পুনঃ আবেদন-নিবেদন এবং প্রার্থনা ও মিনতি চলিতে লাগিল। অবশেষে শিবাজী এক দিন মালেকা আমেনাবানুর চরণে লুণ্ঠিত হইয়া তাঁহার কৃপাভিখারী হইলেন।