তারার মুখমন্ডল সহসা মেঘাবরণ মুক্ত শরচ্চন্দ্রের মত সমুজ্জ্বল হইয়া উঠিল! আনন্দোজ্জ্বাসে তারার হৃদয়ের স্তরে স্তরে এবং শোণিতের কণায় কণায় বিদ্যুৎ চমকিতে লাগিল!! নৈরাশ্যের গ্রীস্ম-জ্বালা পরিশুঙ্ক হৃদয়-তটিনীতে আশা ও আনন্দের বর্ষাকালীন জীমূত-ধারা মূষলধারে বর্ষিত হইতে লাগিল। সে বর্ষণে প্রেমের দু’কূল-প্লাবী বান ডাকিয়া যুবতীর হৃদয় তোলপাড় করিয়া দিল। ঝটিকা-সংক্ষুব্ধ-অম্বুধির ন্যায় তাহা চঞ্চল এবং উত্তাল হইয়া উঠিল।
অতি সত্বর ভৈরবীও বেশ পরিবর্তন করিয়া সাধারণ মারাঠী যুবকের ন্যায় সজ্জিত হইলেন। অতঃপর আবশ্যকীয় দ্রব্যাদি সহ নির্গত হইবার উপক্রম কালে তারা বিঠ্ঠলজীর প্রতিমাটি ভূপাতিত করিয়া পদাঘাতে তাহা ভগ্ন করিয়া ফেলিল! ভৈরবী বলিলেন, “তারা! ছি! ছি! এ করলে কেন? প্রতিমার সহিত প্রতিহিংসা কিসের?
তারাঃ প্রতিহিংসার জন্য নহে। মারাঠীদের ভ্রমাপনোদনের জন্য। তাহারা এই মূর্তিকে জাগ্রত এবং জীবিত বলিয়া জানে! আমার সঙ্গে মত দিন এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। আমি এই প্রমাণ করে গেলাম যে, ইহা প্রস্তর ব্যতীত আর কিছুই নহে। এতে তাদের অনেকের ভ্রান্তি দূর হবে।
ভৈরবীঃ দেখছি, তুমি মূর্তিপূজক কাফেরের ঘরে জন্মগ্রহণ করলেও হযরত ইব্রাহিম খলিলুল্লাহর ন্যায় প্রতিমা চূর্ণ করতে বিশেষ আনন্দ লাভ করে।
অতঃপর ভৈরবী এবং তারা নিশীথের গভীর অন্ধকারের মধ্যে যথাস্থানে যাইয়া নৌকায় আরোহন করিলেন। সুবাতাস বহিতেছিল। নৌকা পাল-ভরে তীরের মত ছুটিয়া চলিল। পাঠক-পাঠিকা! বোধ হয় বুঝিতে পারিতেছেন যে, এই ভৈরবী আর কেহ নহে, ভৈরবী আমাদেরই অসাধারণ তেজঃস্বিনী বিচিত্রকর্মা মালেকা আমেনাবানু।
তারাবাঈ ১৬ পরিচ্ছেদ
নৌকা ভরাপালে জোর বাতাসে কল্ কল্ স্বরে নদীর জলরাশি কাটিয়া তীরের মত বেগে ছুটিল। রাতারাতি নৌকা অনেক দূরে সরিয়া পড়িল। প্রভাত সমাগমে বায়ুর বেগ কিছু মন্দ হইয়া আসিল। দেখিতে দেখিতে বায়ুর প্রবাহ একেবারেই রুদ্ধ হইয়া গেল। সুতরাং মাল্লারা নৌকার পাল নামাইয়া দাঁড় ধরিল। ঝড়ের মত যে নৌকা বায়ুভরে ছুটিয়া যাইতেছিল, এক্ষণে তাহা অপেক্ষাকৃত ধীর মস্থরভাবে যাইতে লাগিল। মালেকা এবং তারা কিছু চিন্তিত হইয়া পড়িলেন। মাল্লাগিদকে যতদূর সম্ভব দ্রুতগতিতে দাঁড় ফেলিবার জন্য পুনঃ পুনঃ আদেশ করিতে লাগিলেন। মাল্লারা যতদূর সম্ভব তীব্র বেগে দাঁড় ফেলিতে লাগিল।
ক্রমশঃ আঁধার ভেদ করিয়া প্রভাতের অরুণিমাজাল পূর্বগগনে দেখা দিল। বিহঙ্গ-কণ্ঠে বিশ্ব-বিধাতার বিবিধ বন্দনা ললিত-স্বরে গীত হইয়া পৃথিবীকে ঝঙ্কৃত করিয়া তুলিল! স্নিগ্ধ গন্ধসহ মৃদু-মন্দ সঞ্চার কুসুম-গন্ধ বহন করিয়া বিশ্ব-বিধাতার মঙ্গলাশীর্বাদের ন্যায় সবত্র প্রবাহিত হইয়া নব জীবনের সূচনা করিতে লাগিল।
নিশাচর প্রাণীদিগের মনে নৈরাশ্য ও ভীতির সঞ্চার এবং দিবাচরদিগের মনে আনন্দ উৎসাহের স্রোত প্রবাহিত করিতে দেখিতে দেখিতে দিবসের আবির্ভাব হইল। দিবা আবির্ভাবে মালেকা এবং তারা স্ত্রীলোকের পরিচ্ছদ পরিত্যাগ পূর্বক মারাঠী পুরুষের বেশে সজ্জিত হইয়া নৌকার ভিতরে অবস্থান করিতে লাগিলেন। নৌকায় কয়েকজন পাঠান বীরপুরুষ আসিয়াছিল; তাঁহারা বীর-পরিচ্ছদ পরিত্যাগ পূর্বক মারাঠী পুরুষের মাল্লাদিগের সাজে সজ্জিত হইলেন।
নৌকা ভরাপালে তীর বেগে গেলে যেখানে তিন দিনে নিরাপদ স্থানে যাইয়া উপস্থিত হইতে পারত, সেখানে বায়ুর গতি রুদ্ধ হওয়ায় শুধু ক্ষেপনী সাহায্যে চারি দিনে অর্ধপথে যাইয়া উপস্থিত হইল।
এদিকে বিঠঠলপুর হইতে ভৈরবী এবং তারার সহসা অন্তর্ধানে এবং দেবমূর্তির ভগ্নদশা দর্শনে পরদিবস প্রাতঃকালেই এক হুলস্থুল কান্ড পড়িয়া গেল! দেবমূর্তির ভগ্নাবস্থা এবং দারুণ অবমাননা দর্শনে সকলেই মর্মাহত হইল! ভৈরবীর সম্বন্ধে নানাজনে নানা মত প্রকাশ করিতে লাগিল।
কেহ ভৈরবীকে নাস্তিক, কেহ উন্মত্ত বলিতে লাগিল। কিন্তু একটি তীক্ষ্ণবুদ্ধি বৃদ্ধা বলিল যে, এই ভৈরবী বাস্তবিক পক্ষে ভৈরবী নহে। এই ভৈরবী নিশ্চয়ই কোন মুসলমান রমণী। রমণী অসাধারণ এখানে আসিয়াছিল। মারাঠীদের ধূর্ততা এবং কৌশলকে এবার মুসলমান রমণী বেশ টেক্কা দিয়াছে। ধন্য রমণীর সাহস এবং বুকেট পাটা! সমস্ত মারাঠীদের মুখ ভোঁতা করিয়া দিয়াছে! কথা তড়িদ্বেগে সর্বত্রই রাষ্ট্র হইয়া পড়িল। ঘটনা শুনিয়া সকলেই অবাক হইল! ভগ্নপ্রতিমা সন্দর্শনে সহস্র সহস্র নরনারী সমাগত হইল। ভৈরবী এবং তারার উদ্দেশ্যে সহস্রকণ্ঠে সহস্রকণ্ঠে অজস্র অভিসম্পাদ এবং সহস্র গালাগালি বর্ষিত হইতে লাগিল। কোনও কোনও প্রাচীন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা তাহাদের আরাধ্য এই ভগ্নমূর্তির শোকে অশ্রুধারা বহাইতে লাগিল। নবীন-নবীনরাও অনেকে দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিল। কেবলমাত্র একটি মারাঠী কুমারী বিস্ময়-বিজড়িত কণ্ঠে বলিল, “ওমা! বিঠ্ঠলজী আমাদের কেমন প্রভু! একজন মুসলমান রমণীর সঙ্গে যুদ্ধেই চুরমার হয়ে গিয়েছে। তবে দেখছি, এসব দেবতা-টেবতা কিছুই নয়-সবই মাটী! সবই ভুয়া! সবই মিথ্যা!”
তাহার কথা শুনিয়া সকলেই জিব কাটিয়া বলিল, “সর্বনাশ! সর্বনাশ! হীরা বলে কি! হিন্দুর মেয়ের মুখে একটি সর্বনেশে কথা! ঘোর কলি! ঘোর কলি!! ধর্ম আর থাকে না।” এই বলিয়া হীরার প্রতি সকলেই তর্জন-গর্জন করিতে লাগিল! হীরাবাঈ তাহাতে আরও ত্যক্ত বিরক্ত হইয়া উত্তেজিত কণ্ঠে বলিল, “আমি কি অন্যায় বলছি? যে-দেবতা নিজেকে রাখতে পারে না, সে আমাদিগকে কেমন করে রাখবে, আমাকে বুঝিয়ে দাও। আমি দিব্য দেখতে পাচ্ছি, এটি একটি বড় পাথরের মূর্তি ছাড়া আর কিছুই নয়! উহাতে ভক্তি করা আর লাথি মারা, সমান কথা।” হীরার কথার ধারে সকলেই কিছুই নয়! উহাকে ভক্তি করা আর লাথি মারা, সমান কথা।” হীরার কথার ধারে সকলেই হতভম্ব হইয়া পড়িল। কেহ কেহ হীরার প্রতি রুখিয়া উঠিল। হীরা ক্রুদ্ধ হইয়া সেখান হইতে চলিয়া গেল।