শিবাজী ভীতি-বিহবলচিত্তে রূদ্ধপ্রায় কণ্ঠে বলিলেন, “মালেকা! আমায় মাফ কর। আর না, যথেষ্ট হয়েছে। দোহাই তোমার, প্রাণবধ করো না! আর কখনও পরনারী হরণ করব না! আর কখনও তোমার প্রতি লালসার দৃষ্টিপাত করব না। আজ হ’তে বুঝলাম, মুসলমান রমণী সতী। সতীত্বের এবং ধর্মের সন্মান মুসলমান রমণীর মত আর কোনও জাতীয়রা রমণীর কাছে আদৃত এবং রতি নহে।”
মালেকার তর্জন-গর্জনে এবং শিবাজীর করুণ প্রার্থনায় সমস্ত গিরিগুহা শব্দায়মান হইয়া উঠায়, ভিতরের প্রহরী এবং দাস-দাসীগণ ব্যস্ত হইয়া ছুটিয়া আসিল। তাহার আসিয়া দেখিল যে, মালেকা আমেনাবানু ভীষণ রণরঙ্গিনী মূর্তিতে ভ্রুকুটি-কুটিল নেত্রে শিবাজীকে পদতলে চাপিয়া দন্ডায়মান! একজন দাসী আনন্দ-উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, “ঠিক হয়েছে, মা! এ যে, উগ্রচন্ডী কালী করালী মূর্তি! পদতলে কাম-কুক্কুর শিবাজী! আজ নরাধমের উপযুক্ত প্রতিশোধ হয়েছে। কি বলব, মা! এই নরাধম কাম-কুক্কুরই আমাকে পাপ-লালসায় ভাসিয়ে স্বকীয় ঘৃণিত পাপ-লিপ্সা চরিতার্থ করেছে। আমি এক্ষণে পুরাতন হয়েছি। তাই নূতন রস ভোগের জন্য নবীনা তোমাকে হরণ করে এনেছে। বেশ হয়েছে, মা! পাষন্ডের উপযুক্ত প্রতিশোধ গ্রহণ কর!”
এই বলিয়া দাসী আনন্দে করতালি দিয়া অট্র হাস্যে সমস্ত গুহা প্রতিধ্বনিত করিতে লাগিল। মালেকা ভীষণ গর্জনে, দন্তে দন্ত সংঘর্ষণ করিয়া আবার বলিলেন, “বল নরাধম কুক্কুর! আর কখনও পরনারীর প্রতি কুভাব পোষণ করবি কি-না?” এই বলিয়া মালেকা আমেনাবানু ছুরিকাখানি বক্ষের দিকে আরও বিনত করিলেন।
শিবাজী ভীত এবং আর্তকণ্ঠে বলিলেনঃ “মালেকা! মালেকা! রক্ষা কর! দোহাই তোমার! আজ হইতে তুমি আমার মাতা! তোমার মাতৃ সম্বোধন করছি। রক্ষা কর, মা! সত্যই তুমি দানবদলনী পাপ-তাপ-নাশিনী দুর্গা। এতদ্ব্যতীত নারীতে কখনও এমন তেজঃ ও সাহসের সঞ্চার সম্ভব নহে।
“মা কর, মা! আমায় মা কর! আজ হ’তে তোমাকে পরম পূজনীয়া জননী বলেই পূজা করব। ধন্য সতী! তুমি শত ধন্য! তোমায় ও পবিত্র পদাঘাতেই কাম-বিকারের নেশা আজ হতে ছুটে গেল। কিন্তু মা! এই পাপী সন্তানের বক্ষ হতে পাদপদ্ম অপসারিত কর, মা! আমার শ্বাস রুদ্ধ হয় আসছে!”
প্রহরী ও দাসদাসীগণ মালেকাবানুর ভীষণ প্রলয়ঙ্কারী মূর্তি সন্দর্শনে সকলেই স্তম্ভিত এবং বিস্মিত হইয়া পড়িয়াছিল। এতক্ষণে তাহাদের মোহ ভঙ্গ হওয়ায় সকলেই “একি কান্ড, মা! ছাড় ছাড়! মহারাজার প্রাণ বধ করে না”-বলিয়া সমস্বরে করুণ চীৎকার করিয়া উঠিল।
মালেকা বক্ষ হইতে দণি পদ তুলিয়া লইয়া একটু দূরে সরিয়া দাঁড়াইলেন। শিবাজী উঠিয়া দাঁড়াইয়া আলুলায়িতকেশা মালেকা আমেনাবানুর পাদপদ্মে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করিয়া যুক্ত করে বলিলেন, “মা! অধম সন্তানের অপরাধ মার্জনা কর। তোমার পূত পদস্পর্শে আমার দিব্যজ্ঞানের উদয় হয়েছে। আমি মহাপাতকী সন্তান, তুমি পুণ্যবতী সাক্ষাৎ জগন্মতা ভবানী। আমার অপরাধ লইও না। আমার ধর্ম-বুদ্ধি সঞ্চারের জন্যই তুমি ও মায়া-প্রপঞ্চ বিস্তার করেছ।” সকলেই দেখিল, শিবাজীর চক্ষু অশ্রুপ্লুত। সত্যই তাঁহার প্রাণে তীব্র অনুতাপের অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত হইয়াছে।
গভীর অন্ধকার ভেদ করিয়া বিশ্বপ্রহলাদিনী ঊষার মৃদু হাস্য যেমন বিশ্ববক্ষে নবজীবনের সঞ্চার করে, তেমনি অদ্যকার এই ভীষণ পাপলিপ্সা এবং কামাসক্তির সূচীভেদ্য অন্ধ তসমা ভেদ করিয়া দিব্যজ্ঞানের কিরণ শিবাজীর কলুষিত অন্তঃকরণে পদ্মের নির্মল সৌন্দর্য এবং বিমল সৌরভ ফুটাইয়া তুলিল। অকস্মাৎ যেন মেঘরাশি বিচ্ছিন্ন করিয়া চন্দ্রমার বিমল জ্যোতিঃ গগনবক্ষে ফুটিয়া উঠিল!
তারাবাঈ ১২ পরিচ্ছেদ
নৈশ-অন্ধকার দূর করিয়া ঊষার শুভ্র আলোক-রেখা পূর্ব-গগণে ফুটিয়া উঠিয়াছে। নানাজাতীয় বিহঙ্গরাজি সুমধুর কুজনে কাননরাজি মুখরিত করিয়া তুলিয়াছে। বিহগকণ্ঠে নানা ছন্দে বিশ্ববিধাতার বন্দনাগীতি গীত হইবার সঙ্গে সঙ্গেই আফজাল খাঁর শিবিরে ফজরের নামাজের সুধাবর্ষী আজান ধ্বনি ধ্বনিত হইল। যোদ্ধৃগণ শীঘ্র শীঘ্র অজু করিয়া উপাসায় মনোনিবেশ করিলেন।
উপাসনা শেষে মোসলেম শিবিরের প্রধান প্রহরী আসিয়া আফজাল খাঁকে নিবেদন করিলেন যে, শেরমর্দান খান এবং তাঁহার অনুচরগণ কেহই তাম্বুতে নাই। পরে প্রকাশ পাইল, তারাবাঈও তাম্বুতে নাই। তাহার জিনিসপত্র সমস্তই পড়িয়া রহিয়াছে। তখন চতুর্দিকে একটি মহা খোঁজ পড়িয়া গেল! নাই-নাই-নাই ত শেরমর্দান খানের দলের কোনও লোকই নাই! চারিদিকে সবাই খুঁজিতে লাগিল। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না।
শিবিরে মহা হুলস্থুল পড়িয়া গেল। সুদ গুপ্তচরদিগকে চুতর্দিকে মারাঠী শিবিরে প্রেরণ করা হইল। ক্রমশঃ জানিতে পারা গেল যে, শেরমর্দান খানই তারাবাঈকে বন্দী করিয়া লইয়া গিয়াছে। শেরমর্দান খান এবং তাহার অনুচরগণ কেহই মুসলমান নহে, সকলেই মারাঠী।
তারাবাঈকে হরণ করিয়া লইয়া যাইবার জন্যই তাহারা মুসলমানের বেশে আসিয়া আফজাল খাঁর সৈন্যদল-ভুক্ত হইয়াছিল।
শেরমর্দান-স্বয়ং মালোজী। এই মালোজীর করেই শিবাজী তারাবাঈকে সমর্পণ করিতে কৃতসংকল্প হইয়াছিলেন। মালোজী তারার রূপ-মাধুরী দর্শনে মুগ্ধ হইয়া গিয়াছিলেন। তারাকে মুসলমান শিবির হইতে উদ্ধার করিবার আর কোনও পথ না পাইয়া অবশেষে মালোজী ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া আফজাল খাঁর সৈন্যদলে ভর্তি হইয়াছিলেন।