গৃহস্থিত প্রদীপের আলোক, রমণীর বিশ্ববিমোহন রূপের ছটায় যেন মলিন বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছে। উন্নত বিশাল বক্ষ শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে বাত্যাহতা স্ফীত বা তরঙ্গায়িত পদ্মার ন্যায় ক্ষণে ক্ষণে উন্নত এবং অবনত হইতেছে।
রমণীর নেত্রকুবলয়ের প্রশান্ত এবং স্থির দৃষ্টি হইতে উন্নত চিন্তার ইঙ্গিতই সূচিত হইতেছে। রমণী যুবতী-প্রস্ফুটিত-যৌবনা এবং অসাধারণ সৌন্দর্যশালিনী হইলেও, তাঁহাকে দর্শন করিয়া কাম-গন্ধী প্রেমের উদ্রেক না হইয়া সশ্রদ্ধ ভালোবাসারই সঞ্চার হয়।
রমণী অলৌকিক সুন্দরী। তাহার মুখমন্ডলে তরুণ অরুণের অরুণিমা, নয়নে বর্ষণ-মুক্ত শারদাকাশের নীলিমা, গঠন-বৈচিত্র্যে কাফ-কৌশলের অপূর্ব মহিমা পরিদূশ্যমা! রমণী নির্বাতি সমুদ্রের জলরাশির ন্যায় তরল সৌন্দর্যে ভরপুর হইয়াও অচঞ্চল! সুতরাং, তাঁহাকে দর্শন করিলে আনন্দ এবং শ্রদ্ধারই উদ্রেক হয়। সে সৌন্দর্য-সে লাবণ্য কেবল কবিত্বময়, রসময় এবং আনন্দময়! তাহাতে স্বপ্নের আবেশ এবং মদিরার বিহবলতা নাই, তাহা স্পষ্ট, মুক্ত এবং ব্যক্ত; সুতরাং সহসা তাহাতে মনশ্চাঞ্চল্য ঘটে না।
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! এই গরীয়সী সুষমা-সম্পন্ন মহিমময়ী রমণী আমাদেরই সেই মালেকা আমেনাবানু। রমণী অর্ধশায়িতাবস্থায় বাম হস্ত বাম কপোলে রাখিয়া দক্ষিণ হস্তে “দেওয়ান হাফেজ” ধারণ করিয়া পড়িতেছিলেন।
এমন সময় শিবাজী তথায় আসিয়া একাকী উপস্থিত হইলেন। মালেকা আমেনা তখন অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া বসিলেন। শিবাজী দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া নিকটবতী একখানি সোফাতে উপবেশন করিলেন। ক্ষণকাল নীরবে যাপন করিবার পরে বলিলেন, “মালেকা! মালেকা! আমার প্রাণের মালেকা! একবার তুমি আমার দিকে মুখ ফিরাও। একটিবার মাত্র কথা শুন। আমি তোমার জন্যই উন্মুত্ত হয়েছি। তোমার প্রেমামৃত পানের জন্যই মানস-চকোর চঞ্চল হয়েছে। কিছুতেই তোমাকে পরিণয় পাশে আবদ্ধ করতে স্বীকৃতা করতে না পেরে অবশেষে তোমাকে হরণ করতে বাধ্য হয়েছি।
“তোমাকে বশীভূত করবার জন্যই অপহরণ করে এই নিভৃত নির্জন গিরিগুহায় নিয়ে এসেছি। তোমার প্রেমে প্রমত্ত হয়ে রাজ্য, ধন-সম্পদ নিসর্জন দিয়েছি। তোমাকে লাভ করতে না পারলে, জীবনের আর কোনও প্রয়োজন নাই।
“হে সুন্দরী! হে মানসি! নব-বসন্তের নব-বিকাশোন্মুখ অবস্থায় অভিমান-ভরে তোমার এই প্রেমদাসকে তুচ্ছ করে উভয়ের অকল্যাণ ও অমঙ্গল আনয়ন করো না। বসন্ত এসেছে, তবে সৌরভ-সুধা বিতরণে বিলম্ব কেন?
“হ মানিনী! শিবাজী দস্যু হলেও রাজা, মারাঠী হ’লেও বীর-পুরুষ, কাফের হলেও প্রেমিক এবং মূর্খ হলেও কৃতজ্ঞ। সুতরাং একেবারে তোমার অযোগ্য নহে। তোমার প্রেম-প্রবাহের রসসিক্ত হ’লে, শিবাজী ভারত-সিংহাসনে সমারূঢ় হ’বারও কল্পনা করে।
“হে বীর্যবতী! তোমার বীরত্ব এবং সাহস সহায় হ’লে, এ বাহু আরও বলশালী হবে, এ মস্তিস্কে আরও উচ্চ উচ্চ রাজনৈতিক চিন্তা-স্রোত প্রবাহিত হবে। তাই বলি, মালেকা! তুমি আমার হৃদয়রাজ্যের মালেকা হ’য়ে মালেকা নামের সার্থকতা সম্পাদন কর। নিশ্চয় জানিও, তোমার প্রেমে হতাশ করলে এ জীবন-তরু অকালে শুঙ্ক হবে। এস মালেকা! এস, আমার বক্ষে এস। নতুবা এই বক্ষে শাণিত ছুরিকা বিদ্ধ করে এ বিদগ্ধ জীবনের অভিনয় শেষ কর।
“ক্রমাগত আজ দু’মাস কাল তোমার সাধনা করে মন বড়ই চঞ্চল এবং বিধুর হয়েছে, আর ধৈর্যধারণ অসম্ভব। মনের স্থৈর্য ক্রমশঃ নষ্ট হচ্ছে। এস তুমি! এস, আমার মরুভূমিতুল্য দগ্ধবক্ষে তুমি মিত্রাপ-জ্বালা-নিবারণী মন্দাকিনীর ধারার ন্যায় প্রবাহিত হও।
“এস মালেকা! এস, তা’তে কোন কলঙ্ক নেই। আমি তোমাকে কলঙ্কিনী করব না। আমি তোমাকে রাজ-আড়ম্বরে যথারীতি বিবাহ করব। ভগবান রামদাস স্বামী আমার অনুকূলে। বাহুবল, অর্থবল, বুদ্ধিবল সমস্তই আমার পদতলে।
“মালেকা! একবার তুমি সম্মতি প্রকাশ কর। আজ দীর্ঘ দু’টি মাস ধরে তোমার সাধনা করছি! তোমার রূপবহিৃতে পতঙ্গের ন্যায় আত্মবিসর্জন করতে বসেছি। হায়! তবুও কি তুমি পাষাণী হয়ে থাকবে? মালেকা! আজ সাধনার শেষ দিন!
“আজ যেমন করেই হউক মনের বাসনা পূর্ণ করব। আজ আর তোমার সম্মতি-অসম্মতির অপো করতে পারি না। এস রূপসি! এস, এস, বক্ষে এস!”
এইরূপ উন্মত্ত প্রলাপ বকিতে বকিতে শিবাজী দুই বাহু প্রসার করিয়া মালেকাকে সহসা আবেষ্টন করিয়া অধর-চুম্বনে উদ্যতপ্রায়। রোষেন্মত্তা মালেকা আমেনাবানু সহসা ক্রুদ্ধা ব্যাঘ্রীর ন্যায় ভীষণ বলে উত্থিত হইয়া শিবাজীকে দূরে ঝটকাইয়া ফেলিলেন। দেওয়ালে আহত হইয়া শিবাজী কতলে ঘূর্ণিত হইয়া ভূতলে পতিত হইলেন, উঠিবার উপক্রম করিলেন। কিন্তু শক্তিশালীনী মালেকা সহসা ভীমবলে পদতলে শিবাজীকে চাপিয়া ধরিয়া দৃঢ়মুষ্টিতে শাণিত ছুরিকা বক্ষ-লক্ষে উদ্যত করিয়া বলিলেন, “বল দুরাত্মন। বল জাহান্নামী কাফের! বল কাম-কুক্কুর! পাষন্ড শয়তান। আর কখনও নারী হরণ করবি? পাষন্ড, আজ হ’তে তোর জীবনের পাপভিনয়ের শেষ করব।”
মালেকা ভীষণ ক্রুদ্ধ মূর্তিতে ক্রকুটি-কুটিল আঁখিতে বিকীরণ করিয়া এবং ক্রোধাবেগে কম্পিত হইতে হইতে ভীষণ গর্জন করিয়া শিবাজীকে পদতলে আরও ভীষণভাবে চাপিয়া ধরিলেন। ছুরিকার শাণিত মৃত্যুর করালী জিহবার ন্যায় শিবাজীর চক্ষে প্রতিভাত হইল!