মধ্যে মধ্যে সন্দেহবশে কয়েকজনকে ধৃত করায়, তাহার মারাঠী গুপ্তচর বলিয়া প্রকাশ পাওয়ায় পাহারা আরও কড়াকড়ি করা হইল। মালেকা আমেনা বানু বুঝিতে পারিলেন যে, তাঁহাকে এবং শিবাজী-নন্দিনী তারাবাঈকে কোনও রূপে বন্দী বা নিদ্রিতাবস্থায় চুরি করিয়া লইবার জন্য শিবাজীর দলপতিগণ বিশেষ তদবির করিতেছেন।
মালেকা এবং তারাবাঈ সাবধানতার জন্য অস্ত্র-পাণি হইয়া শয়ন করিতেন। মারাঠীরা যে-কোনওরূপে এই সুন্দরীদ্বয়ের কাহাকেও অপহরণ করিতে সমর্থ হইবে, তাহা কেহ স্বপ্নেও চিন্তা করিলেন না। মোতামদ খান স্বয়ং রাত্রিতে মালেকা এবং তাঁহার শিবিরের প্রহরীদিগের সতর্কতার জন্য বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করিলেন।
কিন্তু মানুষ যখন যে-বিষয়ে অতিরিক্ত সাবধান হয়, অনেক সময় যেমন তাহাতেই অসম্ভাবিতরূপে বিপদ ঘটিয়া থাকে; তেমনি এই সাবধানতার মধ্যেও গুরুতর বিপদ সংঘটিত হইল।
সহসা এক দিন প্রভাতে দেখা গেল যে মালেকার শিবিরে মালেকা নাই। তাঁহার শিবিরের মধ্যে একটি গর্ত রহিয়াছে। অনুসন্ধানে দেখা গেল, তাহা গর্ত নহে সুড়ঙ্গ। অশ্রু বক্র পথে পনর শত হস্ত পরিমিত সুড়ঙ্গ কাটিয়া মালেকাকে গভীর নিশীথে নিদ্রিয়বস্থায় বেহুঁশ করিয়া অপহরণ করিয়াছে।
অতঃপর সেই সুড়ঙ্গ পথে নামিয়া ধীরে ধীরে সকলে এক বনের মধ্যদেশে একখন্ড পরিস্কৃত ভূমি দেখিতে পাইলেন। সেখানে কিছু পূর্বেও লোক ছিল, তাহা বেশ বুঝিতে পারা গেল। সুড়ঙ্গের মাটিগুলি একস্থানে রাশীকৃত না করিয়া ক্রমশঃ নদীর জলে ফেলিয়া দেওয়া হইয়াছে।
সুড়ঙ্গের মুখে একটি লতাগুল্মের ঝোপ রহিয়াছে। এমন কৌশলপূর্ণ স্থান যে, দেখিয়াও সহসা কেহ কিছু নির্ধারণ করিতে পারে না।
মালেকা আমেনা বানুকে যে মারাঠীরা অচিন্ত্যভাবে সুদীর্ঘ সুড়ঙ্গ খনন করিয়া অপহরণ করিয়া লইয়াছে, সে-বিষয়ে কাহারও আর কোনও সন্দেহ রহিল না। মালেকার জন্য মোসলেম শিবিরে ভীষণ হাহাকার পড়িয়া গেল! আফজাল খাঁ যার-পর-নাই শোকার্ত হইয়া পড়িলেন। সৈন্য-সামন্ত সকলেই বিষাদ-সাগরে নিমগ্ন হইল!
তারাবাঈ তাঁহার আশ্রয়দাত্রী এবং পরম হিতৈষিণী মালেকার অপহরণে যার-পর-নাই ক্ষুণ্নমনা এবং বিষাদের বিমলিন হইয়া অশ্রু বর্ষণ করিতে লাগিলেন।
আমেনা বানুর মাতা শোকে পাগলিনী হইয়া উঠিলেন। পাছে বা ধর্মাধর্ম জ্ঞানশূন্য পাষন্ড কাফেরগণ এই মোসলেম সুন্দরীকে কলঙ্কিত অথবা নিহত করে, ইহা ভাবিয়া সকলেই পেরেশান ও লবেজান হইয়া উঠিলেন।
দরী-গিরি, বন-জঙ্গল, নদ-নালা, সমস্ত তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করা হইল। মারাঠীদিগকে ভীষণভাবে যত্র তত্র আক্রমণ করিয়া বিপর্যস্ত ও বিধ্বত করতঃ বিশেষভাবে অনুসন্ধান করা হইল! কিন্তু কোথায়ও কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না।
অনেক মারাঠীকে বন্দী করিয়া বিশেষ প্রলোভন এবং প্রাণদণ্ডের ভয় দেখাইয়াও তাহাদের নিকট হইতে কোনও তত্ত্ব পাওয়া গেল না। চতুর্দিকে বহু গুপ্তচর প্রেরণ করিয়াও কোনও সূত্র আবিস্কার করা গেল না। সকলেই যার-পর-নাই নিমর্ষ ও শোকাকুল চিত্তে দিন-যাপন করিতে লাগিলেন।
মহাবীর আফজাল খাঁ এবং বীরবর মোতামদ খান নানা প্রকার নূতন নূতন পন্থা এবং কৌশল অবলম্বন করিয়া মালেকার অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। শিবাজীকে বন্দী করিতে পারিলে, সমস্ত উদ্দেশ্যই সিদ্ধ হইবে বুঝিয়া, শিবাজীকে বন্দী করিবার জন্য অনেক চেষ্টা করিতে লাগলেন।
কিন্তু বিশেষ অনুসন্ধানে জানা গেল যে, শিবাজী তখন আবহক্ষেত্রে উপস্থিত নাই। সেনাপতি আবাজী তখন শিবাজীর প্রতিনিধি যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান করিতেছেন। অতঃপর শিবাজীর অবস্থান নিরূপণের জন্য বিশেষ চেষ্টা হইতে লাগিল।
তারাবাঈ ১১ পরিচ্ছেদ
গভীর রজনী। চতুর্দিক নিবিড় অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন। পশ্চিমঘাট গিরিগহবরের একটা মনোহর কক্ষ বিশেষরূপে সজ্জিত। এই নির্জন রাজা অশোকের সময় শ্রমণদিগের নির্বাস জন্য নির্মিত হইয়াছিল।
গভীর নির্জনে বাস করিবার উদ্দেশ্যেই এই সমস্ত কৃত্রিম গুহা খোদিত করা হইয়াছিল। মধ্যে মধ্যে তিনি শক্রর অনুসরণ অব্যাহতি এবং যুদ্ধ হইতে বিশ্রাম লাভ করিবার জন্য এই নির্জন গিরিহুহার বাস এবং স্বকীয় ভোগলালসা পরিতৃপ্তি করিতেন।
এইখানেই ভীষণ হত্যা এবং লুণ্ঠনের গুপ্ত পরামর্শ হইত। গভীর বনরাজিপূর্ণ এই দুর্গম পর্বতের পাদমূলে ভীষণ অরণ্যের সম্মুখে একটি পরিখা খোদিত ছিল। লোকে তাহাকে পার্বত্য নদী বলিয়াই মনে করিত।
পরিখার উভয় পার্শ্বে উচ্চ গড়; তাহা নানাজাতীয় বৃলতা বিশেষতঃ বৃহৎ বৃহৎ শাল ও তালবৃক্ষে সমাচ্ছন্ন হইয়া স্বাভাবিক ক্ষুদ্র পর্বতের স্তুপ বলিয়া ভ্রম জন্মাইত! গড়ের উপরে নানা স্থানে বৃরাজির পাদমূলের অন্তরালে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ তোপ সজ্জিত ছিল।
এতদ্ব্যতীত বনের নানা স্থানে অদৃশ্যভাবে তোপ সজ্জা ছিল। বনের মধ্যে মৃত্তিকার নীচে কয়েকটি পাতালপুরী বা গুপ্ত-কক্ষ ছিল। এই সমস্ত পাতাল-গৃহে নানাবিধ যুদ্ধের উপকরণ, লুণ্ঠিত সামগ্রী এবং ধন-ভান্ডার সংস্থাপিত ছিল। এই গোপনীয় গুহাবলীর একটি প্রশস্ত এবং অধিকতর রমণীয় গুহাতে ললনাকুল ললাম-ভূতা এক ষোড়শী রূপসী রূপের ছটায় কক্ষ আলোকিত করিয়া একখানি পালঙ্কোপরি অর্ধহেলিত অবস্থায় অবস্থিত!
রমণীর ঈষৎ কুঞ্চিত সুচিক্কণ ঈষন্নী লাভ কেশকলাপ ললাট এবং গন্ডে পতিত হওয়ায় তাহার মুখখানি শৈবালে ঈষদাচ্ছন্ন প্রভাত-প্রস্ফুটিত কমলের ন্যায় অথবা মেঘ-কিরীট-চন্দ্রমায় ন্যায় শোভা পাইতেছে। সে মুখের ও চক্ষুর ছটায় তেজস্বিতা, দৃঢ়তা এবং পবিত্রতার আভাই কেবল বিকীর্ণ হইতেছে।