শিবাজী-নন্দিনী আর কিছু বলিতে পারিলেন না। উচ্ছ্বসিত প্রেমাবেগে সন্দেহ এবং আশঙ্কায় তাহার পদ্মপলাশলোচন হইতে তরল মুক্তাধারা নির্গত হইতে লাগিল।
হে রমণী অনিশ্চিত প্রেমের আশায় চিত্তের উন্মাদনায় পিতামাতা আত্মীয়-স্বজনের স্নেহের বন্ধন খন্ডন করিয়া তাহার প্রেমাস্পদের সেবায় উপস্থিত হইয়া পিপাসা পরিতৃপ্তি করিতে পারিতেছে না, তাহার প্রেমাস্পদের নিকটে নিজের অবস্থার বিবরণ খুলিয়া বলিতে যাইয়া শোকাবেগে ক্রন্দন করা নিতান্তই স্বাভাবিক।
আফজাল খাঁ সুন্দরীর প্রেমোচ্ছ্বাস এবং হৃদয়ের অবাক হইয়া গেলেন। মনের ভিতর দ্রবীভূত হইয়া নিতান্ত চাঞ্চল্য অভিভূত এবং প্রেমের ধারায় অভিসিক্ত হইলেন। অন্তরে বাহিরে তখন মহাবীর আফজাল খাঁর তুমুল ঝটিকা প্রবাহিত হইল। প্রাণের পরতে পরতে অনন্ত পুলক শিহরিয়া উঠিতে লাগিল! নব বসন্তের মলয়া হাওয়ার প্রথম চুম্বনে শীত-সঙ্কুচিত কুসুমকলিকাগুলি যেমন শিহরিয়া উঠিয়া ফুটিয়া উঠে, আফজাল খাঁর হৃদয়-মালঞ্চ তেমনি শিহরিয়া উঠিয়া প্রেমের পুস্পে ভরিয়া গেল।
অনন্ত প্রেমের কুসুম-সুষমার মোহিনী আভা, সন্ধাকাশে স্বর্ণমেঘের ন্যায় হৃদয় জুড়িয়া বসিল। হৃদয়ে হৃদয়ে আভা ফুটিল। মরমে মরমে বাণ ছুটিল। তখন আগ্রহ ও ব্যগ্রতায় হৃদয়-কুঞ্জে প্রেমের কোকিল পাপিয়া অবিরাম কুজনে ডাকিতে লাগিল।
আফজাল খাঁ প্রেমাবেশে সেই নির্জন দীপালোক-আলোকিত-কক্ষে শিবাজী-নন্দিনীকে বুকের ভিতরে টানিয়া লইয়া তাহার গোলাপী গন্ডে কয়েকটি চুম্বন দান করিলেন। প্রদীপ-শিখা একটু কাঁপিয়া উঠিল! যুবতীর হৃদয় লজ্জা ও প্রেমে সঙ্কুচিত অথচ সহর্ষ হইয়া উঠিল।
উভয়েই ক্ষণকাল নীরব। উভয়ের বক্ষের স্পন্দন দ্রুত চলিতে লাগিল। উভয়ে উভয়ের গভীর প্রেমালিঙ্গনে আবদ্ধ। মারাঠা রাজকুমারীর নেত্র-কুবলয় হইতে প্রেমের মুক্তধারা বর্ষিত হইয়া পাঠানবীরের বক্ষস্থল বিপ্লাবিত করিতে লাগিল।
তারাবাঈ ১০ পরিচ্ছেদ
বিজাপুরের সোলতানের পক্ষ হইতে পঞ্চদশ সহস্র, পদাতিক, দুই সহস্র অশ্বারোহী, সাতশত গোলন্দাজ সৈন্য কৃষ্ণগড়ে সমাগত হইয়াছে। শিবাজীর বিশ্বাসঘাতকতা এবং নৃশংস ব্যবহারের সংবাদ শ্রবণে ক্রুদ্ধ এবং বিরক্ত হইয়া বিজাপুর দরবার শিবাজীকে সমস্ত দস্যু-সৈন্যসহ ধ্বংস করিতে এই সৈন্যদল প্রেরণ করেন।
আফজাল খাঁ কৃষ্ণগড়ে রাজকীয় বাহিনীর আগমন আশায় অপেক্ষা করিতেছিলেন। যথাসময়ে এই নূতন বাহিনী কৃষ্ণগড়ে সমাগত হইলে, মহাবীর আফজাল খাঁ শিবাজীর সহিত যুদ্ধার্থ প্রস্তুত হইলেন। শিবাজীর প্রতি নিতান্ত রুষ্ট এবং বিরক্ত হইয়া মালেকা আমেনা বানুও ইসলামের মহাশক্র শিবাজীর ধ্বংস সাধন মানসে মহাবীর আফজাল খাঁর সহিত যোগদান করিলেন।
ক্রমাগত যুদ্ধ চলিতে লাগিল। শিবাজী সন্মুখ-সমরে অক্ষম হইয়া ক্রমাগত পশ্চাদবর্তন করিতে করিতে সহ্যাদ্রি পর্বতের দুর্গম অরণ্য এবং গিরিগহবর পরিপূর্ণ স্থানে যাইয়া আশ্রয় লইলেন। হঠাৎ আক্রমণ, গুপ্ত আক্রমণ এবং নৈশ আক্রমণ এই তিন আক্রমণ দ্বারা মধ্যে মধ্যে মোসলেম বাহিনীকে বিপদাপন্ন এবং চঞ্চল করিতে লাগিলেন। মোসলেম সৈন্য তাহার দস্যুসৈন্যের অনুসরণ করিলে তাহারা ছত্রভঙ্গ হইয়া নিবিড় অরণ্যানী এবং পর্বতের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া ফেরুপালের ন্যায় লুক্কায়িত হইয়া পড়িত। ফলতঃ শিবাজীর মাওয়ালী দস্যুগণ পলায়নে এবং হঠাৎ আক্রমণে যার-পর-নাই অভ্যস্ত হইয়াছিল!
তাহাদের পলায়ন এবং আক্রমণ বস্ততঃই শৃগালের ন্যায় দ্রুত এবং কৌশলপূর্ণ ছিল। ফলতঃ শিবাজীর নামের অর্থ তাঁহার কার্যের সঙ্গে বেশ সার্থক হইয়াছিল। তখনকার দিনে “শিবাজী দরহকিকত শিবাজী আস্ত।” অর্থাৎ শিবাজী কার্যতঃ যথার্থ “শৃগাল,” একথা দাক্ষিণাত্যের সর্বত্রই প্রবাদবাক্যের ন্যায় প্রচলিত হইয়াছিল।
শিবাজীর ধূর্ততা, ছলনা এবং মিথ্যাবাদিতার কিছু ইয়ত্তা ছিল না। স্বাধীন রাজ্য স্থাপনের আকাঙা তাঁহাকে এমনি অধীর ও আকুল করিয়া তুলিয়াছিল যে, তিনি তাঁহার অভীষ্ট সাধন মানসে কোনও প্রকার পাপ ও অন্যায়কে বিন্দুমাত্রও পরওয়া করিতেন না।
খুন, জখম, চৌর্য, প্রবঞ্চনা তাঁহার জীবনের নিত্য কর্তব্যকর্ম মধ্যে পরিগণিত ছিল। এহেন ধূর্ত শিবাজীর সহিত পুনঃ পুনঃ সন্মুখ-সমরে চেষ্টা করিয়াও আফজাল খাঁ কৃতকার্য হইতে পারিলেন না। তরঙ্গায়িত উচ্চাবাস ভূমি, নিবিড় অরণ্য, পর্বতের অসংখ্য গুহা এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পার্বত্য-নদীর গর্ভ ও উচ্চপাড়ের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া শিবাজী মধ্যে মধ্যে ‘রাতহানা’ দিয়া বিজাপুরের সুশিতি বাহিনীকে যার-পর-নাই ত্যক্ত-বিরক্ত করিতে লাগিলেন।
পার্বত্য প্রদেশে দস্যুদলের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া জয়লাভ করা বহু বিলম্ব এবং ক্ষতি সাপেক্ষ দেখিয়া, বীরাঙ্গনা মালেকা আমেনা বানু শিবাজীর জন্মভূমি রায়গড় আক্রমণ করাই ন্যায়সঙ্গত মনে করিলেন। রায়গড় আক্রমণ করিলে, শিবাজী বাধ্য হইয়া সন্মুখ-যুদ্ধ দান করিতে বাধ্য হইবেন বলিয়া, মালেকা আমেনা বানু আফজাল খাঁকে উৎসাহিত করিতে লাগিলেন।
কিন্তু আফজাল খাঁ এই পার্বত্য প্রদেশেই শিবাজীকে হীনবল এবং ধৃত করিবার জন্য নানা প্রকার কায়দা-কৌশল এবং ফন্দী খাটাইতে লাগিলেন। মাওয়ালী ও মারাঠী দস্যুগণ ছদ্মবেশ ধারণ এবং চৌর্যকার্যেও বিলক্ষণ পটু ছিল। রাত্রিতে তাহারা নানা প্রকার পশু, বিশেষতঃ গরু-ঘোড়ার কৃত্রিম বেশে আসিয়া মুসলমান শিবিরের খোঁজ-খবর লইয়া যাইত। পার্বত্য রমণীদিগের রূপ ধারণ করিয়া দিবসে তাহারা নানা প্রকার ফলমূল এবং তরিতরকারীও বিক্রয় করিতে আসিত।