“অতঃপর নিঃশব্দ পদসঞ্চারে সেই গৃহের অবরুদ্ধ জানালা সংলগ্ন হয়ে এই ভীষণ ষড়যন্ত্রের সমস্ত কথাই শুনতে পেলাম। শিকারে যাবার কথা এবং শিকারে লয়ে লয়ে যেয়ে কৃষ্ণগড়ের নিকটবর্তী গিরিসঙ্কটে ঘোড়াডুবি-গর্তের মধ্যে কৌশলে নিক্ষেপপূর্বক প্রাণবধ করবার সমস্ত কথা শ্রবণ করে আমি যার-পর-নাই আকুল ও অস্থির হয়ে উঠি।
“কি করব, কোন উপায়ে আপনাকে রক্ষা করব, একান্ত মনে কেবল তাই অবিরাম কয়েকদিন পর্যন্ত চিন্তা করি। অবশেষে মনে করলাম, গোপনে কোনও রূপে দেখা করে বা পত্র দিয়ে আপনাকে সাবধান করে দিব। এইরূপ চিন্তায় একান্ত উন্মনা হয়ে আমার ধাত্রীমাতাকে সমস্ত কথা খুলে বলে তাঁর চরণ ধারণ করলাম। তিনি আমাকে নিবৃত্ত হবার জন্য অনেক বুঝালাম; কিন্তু তাতে আমি আরও অধীর ও ব্যাকুল হয়ে পড়লাম। আপনার অহিত বা অনিষ্ট হলে আমি যে গলায় ছুরি নিব, তা’ তাঁকে বিশেষ দৃঢ়তার সহিত বললাম। তিনি গোপনে আপনার সহিত সাক্ষাৎ করে আপনাকে সাবধান করে দিবেন বলে যে-দিন স্বীকার করলেন, দুঃখের বিষয় যে সেই দিনই আপনি পিতার সহিত সহসা শিকারে বহির্গত হয় পড়লেন।
“আপনার মৃগয়ায় গমনের পরে আমি ধাত্রীমাতার সাহায্যে আপনার উদ্দেশে জনৈক ভৃত্যকে আমার বহুমূল্য হার প্রদানের অঙ্গীকারে সঙ্গে লয়ে গভীর নিশীথের অন্ধকারে অশ্বারোহণে কৃষ্ণগড়াভিমুখে যাত্রা করি। অনুমানের উপর নির্ভর করে আমার সেই প্রাচীন ভৃত্যটি ইঙ্গিতে একটি পার্বত্য পথ দিয়ে আপনার নিকট উপস্থিত হই। পাছে কেউ ধরে ফেলে, এই ভয়েই চকিতে বিদ্যুৎ-গতিতে পত্র দিয়েই পলায়ন করি এবং অবিলম্বে কৃষ্ণগড়ের রানী মালেকা আমিনা বানুর নিকটে উপস্থিত হই। তিনি যখন আমাদের বাটী গিয়েছিলেন, তখন তাঁর সহিত আমার গভীর প্রণয়ের সঞ্চার হয়। তাঁর নিকটে উপস্থিত হয়ে আপনার পথের বিপদ এবং গুপ্ত সৈন্যের অবস্থানের কথা নিবেদন করে, আপনাকে রক্ষা করবার জন্য বিশেষ অনুরোধ করি।
“সেই সূত্রে তিনি একশত তেজস্বী ও বিক্রান্ত অশ্বারোহী পাঠান সৈন্য লয়ে আমাদের উদ্ধারের জন্য সহসা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন। পরমেশ্বরকে অনন্ত ধন্যবাদ যে, এই হতভাগিনীর চেষ্টা ও উদ্যম, আপনার জীবন রক্ষায় কতকটা সফল হয়েছে। আর কিছু পূর্বে মালেকার সৈন্যদল, ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারলে, আপনি এরূপ গুরুতরভাবে জখম হতেন না। যা’ হোক, পরমেশ্বরের ইচ্ছায় এবং হাকিম সাহেবের চেষ্টায় আঘাত প্রায় আরোগ্য হয়ে এসেছে। আর দু’চার দিনের মধ্যেই আপনি সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করবেন।”
আফজাল খাঁ বলিলেন, “বিশ্বস্রষ্টার কৌশল ও মহিমা অপরিসীম! যিনি তোমার পিতার অন্তঃকরণে ভীষণ কুটিলতা ও হিংসার বিষ প্রদান করেছেন, সেই তিনিই আবার তোমার অন্তঃকরণ কোমলতা এবং প্রেমের সুধায় পরিপূর্ণ করেছেন! যিনি পাষাণকে কঠিন ও নীরস করে সৃষ্ট করেছেন, সেই তিনিই পাষাণের বক্ষ ভেদ করে তরল নির্মল জলের ধারা প্রবাহিত করেছেন।
“একই বৃন্তে একই উপাদানে তিনি কুসুম ও কণ্টক সৃষ্টি করেছেন। তাঁর রহস্য, তাঁর মহিমা সকল। বিচিত্র ও কৌশলময়! তিনি কোমল কুসুমের কঠিন ফলের জন্ম দেন। আবার কঠিন ফলের মধ্যেই সুমিষ্ট রস ও সুশীতল স্নিগ্ধ বারি রক্ষা করেন। অনন্ত তাঁর মহিমা! অপরিসীম তাঁর কুদরত! তাঁকে ধন্যবাদ দাও।
“যিনি তোমার হৃদয়ে প্রেমের আগুন জ্বালিয়ে আমাকে রক্ষা করেছেন, যিনি তোমাকে কল্যাণের পথে পরিচালিত এবং তোমার প্রেমতৃষ্ণাকে তৃপ্তি দান করুন, এই প্রার্থনা করি।”
তারাবাঈ বলিলেন, “সেনাপতে! হৃদয়ের আকুল উন্মাদনায় তোমার জন্য গৃহত্যাগ করে আজ অরণ্যে চলে এসেছি। এখন তোমার পূজায় মন্দিরে যদি স্থান দাও, তোমার পূজায় লাগব, আর যদি স্থান না পাই, তবে অকালে জীবনকুসুম শুঙ্ক হয়ে ঝড়ে পড়বে! যেদিন হ’তে তোমাকে দেখেছি, সেইদিন হতেই সব ভুলে তোমাকে মজেছি। সেইদিন হতে তোমার চরণকমলের ধ্যান ব্যতীত দেবাদিদের মহেশ্বর শিবের ধ্যান আর করতে পারি নাই। মহেশ্বরকে যে ফুল ও বিল্বপত্র যুগিয়েছি, তা’ তোমার চরণেদ্দ্যেশেই যুগিয়েছে। সেইদিন হতে তোমার মোহনমূর্তি আমি শয়নে-স্বপনে, নিদ্রা-স্বপনে, নিদ্রা-জাগরণে এক মুহূর্তের জন্যও নিস্মৃত হতে পারি নাই।
“মনকে যত বুঝাতে লাগলাম, মত ততই অবুঝ হয়ে উঠতে লাগল; যতই ধৈর্যধারণ করতে চেষ্টা করলাম ততই অধীর ও উন্মত্ত হয়ে উঠল! চুম্বক যেমন লৌহকে আকর্ষণ করে, তোমার হৃদয় তেমনি আমাকে আকর্ষণ করেছে! এ আকর্ষণে এ সন্মিলনে বাধা দিবার শক্তি কা’রও নাই!
“তুমি বিজাপুর রাজ্যের প্রধান সেনাপতি। তুমি একজন মস্ত বীর পুরুষ! তোমার সস্মুখে যশঃসন্ধান ও উচ্চপদ নিয়তই তোমাকে প্রলুব্ধ করছে! তুমি আমার জীবন-বসন্তের মলয়ানিল, হৃদয়-আকাশের চূর্ণ চন্দ্রমা এবং ঊষার আকাশে শুকতারা হলেও, আমি তোমার সম্পূর্ণ অযোগ্য। কিন্তু আমার হৃদয়ের ক্ষুদ্র নদী আজ তোমার উদ্দেশে-তোমার প্রেম-পরিপূর্ণ হৃদয়-পারাবার পানেই ছুটে চলেছে।
“তার গতি অবাধ! সে আজ আত্মহারা অবশভাবে ছুটে চলেছে। তার পরিণামে কি হবে, তদ্বিষয়ে সে কিছুমাত্র চিন্তা না করেই তোমাতেই আত্ম বিকিয়ে বসেছে! হে প্রাণেশ্বর! হে স্বামিন! হে আমার জীবন-প্রভাতের হোমন ঊষা! হে জীবনবারিধির কৌস্তভ রতন! এখন তোমার আদর-অনাদরেই এ হতভাগিনীর জীবন-মরণ নির্ভর করে।”