এমন সময় সহসা সমস্ত কোলাহল নিবারণ করিয়া অতি ঘন চটাপট অশ্বপদ ধ্বনি শ্রুত হইল। দেখিতে দেখিতে পঞ্চাবিংশতি মোসলেম বীর পুরুষ বিদ্যুৎ গতিতে ভীষণ তরবারি হস্তে সংহারক বেশে শিবাজীর সৈন্যদলের উপর প্রচন্ড বার্তাবর্ত কিংবা সামুদ্রিক উচ্চড ঊর্মির ন্যায় ছুটিয়া পড়িল। তাহার সকলেই বর্মমন্ডিত ছিল। একজন যুবক বীরপুরুষ ভীষণ তেজে শিবাজীর উপরে আসিয়া পড়িলেন! তরবারির ভীষণ আঘাতে শিবাজীর লৌহ-ঢাল বিদীর্ণ করিয়া তাঁহার মস্তক আহত করিয়া ফেলিল।
শিবাজী ভীষণ চীৎকার করিয়া দ্রুত অশ্ব ধাবন করতঃ প্রাণ রক্ষার্থে জঙ্গলের অভ্যন্তরে পলায়ন করিলেন। অত্যল্প সময় মধ্যেই সমরক্ষেত্র নির্জন হইয়া পড়িল। শীতল জলধারা অনবরতঃ মস্তকে বর্ষণ করায় এবং তস্থানে প্রলেপ দিয়া পাটি বাঁধিয়া দেওয়ায় অল্পণ মধ্যেই আফজাল খাঁর চৈতন্য সঞ্চার হইল। অতঃপর তাঁহাকে এবং আহত মোসলেম সৈন্যদিগকে কোনওরূপে অশ্বপৃষ্ঠে সমারূঢ় করিয়া কৃষ্ণগড়ের কেল্লার দিকে আগন্তুক বীর-পুরুষ অগ্রসর হইবার উপক্রম করিলে, আফজাল খাঁ বলিলেন, “হে বীরপুরুষ! আপনার দয়া ও মহানুভবতা অপরিসীম! আপনার ঋণ অপরিশোধ্য! আপনার সহানুভূতি অতুলনীয়! আপনি মঙ্গলের জন্যই আমাকে কৃষ্ণগড়ের দুর্গে লয়ে যেতে চাচ্ছেন, আমি সেজন্য আপনার নিকট কৃতজ্ঞ। কিন্তু, হে মিত্রবর! আপনার ন্যায় মহাজন ও বন্ধুজনের পরিচয় প্রদান করলে প্রাণের ভিতরে গভীর শান্তি ও আরাম পাব।”
আগন্তক বীর পুরুষ কিয়ৎকাল নীরবে দন্ডায়মান রহিলেন। অতঃপর বামাকণ্ঠে সকলের বিস্ময় উৎপাদনপূর্বক বলিলেঃ “মহানুভব সেনাপতে! আমার পরিচয় অতি সামান্য। আমি কৃষ্ণগড় দুর্গের জায়গীরদার সরফরাজ খাঁর কন্যা আমিনা বানু। সুদক্ষ গুপ্ত সন্ধানীর নিকট আপনার তত্ত্ব এবং আপনাকে নিহত করার জন্য নৃশংসপ্রকৃতি শিবাজী যে ভীষণ ষড়যন্ত্র করেছিলেন, তা’ অবগত হয়ে অতীব ব্যস্ততা সহকারে দ্রুত রণসজ্জাপূর্বক বীরপুরুষগণকে সঙ্গে লয়ে আপনার সাহায্যের জন্য এখানে আগমন করেছি।”
আফজাল খাঁ আমিনা বানুর পরিচয় লাভ করিয়া নিতান্ত প্রীত ও আনন্দিত হইয়া পুনঃ পুনঃ আশীর্বাদ করিলেন। অনন্তর আমিনা বানু আফজাল খাঁকে লইয়া দুর্গের দিকে অগ্রসর হইলেন।
তারাবাঈ ০৯ পরিচ্ছেদ
একটি মনোহর ও প্রশস্ত কক্ষ মধ্যে একটি অনতিউচ্চ পর্যাঙ্কে মহাবীর আফজাল খাঁ শায়িত রহিয়াছেন। একজন হাকিম, দুইজন দাসী এবং স্বয়ং তারাবাঈ প্রাণপণে তাঁহার সেবা শুশ্রূষায় পরিলিপ্ত রহিয়াছেন। গৃহের ছাদের দোদুল্যমান শতবাহুবিশিষ্ট ঝাড় প্রোজ্জ্বলিত হইয়া উজ্জ্বল আলোকে গৃহতল আলোকিত করিয়াছে। ক্রমে রাত্রি বেশি হইলে, হাকিম সাহেব চলিয়া গেলেন। দাসী দুইটিও কান্তরে যাইয়া শয়ন করিল। তখন তারাবাঈ সময় পাইয়া ধীরে ধীরে আফজাল খাঁর ললাটে ও মস্তকে হস্ত বুলাইতে লাগিল। দুইজন দুইজনকে দর্শন করিয়া গভীর প্রেমাবেশে অভিভূত হইতে লাগিলেন। আফজাল খাঁ দেখিলেন, তারা অসাধারণ সুন্দরী। তাহার প্রশস্ত ললাট, আয়ত চক্ষু, উন্নত নাশিকা, আরক্তিম গন্ড, শঙ্খবিনিন্দিত কণ্ঠ সমস্তই চিত্তাবর্ষক এবং মনোহর। তাহার টানাটানি বাঁকা ভুরু আর তাহার নিন্মে সেই ডাগর ও উজ্জ্বল চক্ষুর লাস্যময় বিদ্যুৎ-কটাক্ষে মুনির মনও বিচলিত হইয়া যায়। সুন্দরীর যৌবন-কুসুম মনোহর ভঙ্গিতে বক্ষ-সাগরের বিকাশোন্মুখ সঞ্চার করে। সুন্দরীর বাহু, অধরোষ্ঠ, তালু, অংস, বক্ষ সমস্তই সুবিভক্ত এবং সুবিন্যস্ত। আফজাল খাঁ তারাবাঈ-এই সৌন্দর্য দেখিয়া আশ্চর্যান্বিত হইয়া গেলেন। কৃষ্ণবর্ণ মারাঠীর ঘরে ইরান-তুরানের এই অপরূপ সৌন্দর্য কেমন করিয়া জন্মগ্রহণ করিল! বস্তুতঃ, তারাবাঈ-এর বেশ পরিবর্তন করিয়া, কোনও শাহজাদীর পোশাকে তাহাকে সজ্জিত করিলে কেহই তাহাকে মারাঠী-সুন্দরী বলিয়া অনুধাবন করিতে পারিবে না। আফজাল খাঁ তারাকে যতই দেখিতে লাগিলেন, ততই মুগ্ধ হইতে লাগিলেন। তারার গোলাপের ন্যায় সুন্দর ও কমনীয় হস্তখানি নিজ হস্তে ধীরে ধীরে চাপিয়া ধরিয়া বলিলেন, “তারা! তোমার ঋণ শোধ করা সুকঠিন। তোমার সতর্কতা, বুদ্ধিমত্তা এবং প্রেমেই আমার জীবন রক্ষা হয়েছে। তুমি যদি সেদিন সৈনিকের ছদ্মবেশে সাবধানতাসূচক পত্রখানি না দিতে, তা’ হলে আমি দেহরক্ষী সৈন্যসহ ঘোড়াডুবি-গর্তে পড়ে প্রাণ হারাতাম। তোমার পিতা যে এরূপ নিদারুণ বিশ্বাসঘাতকতা এবং ষড়যন্ত্র করবেন, তা’ আমার স্বপ্নের অগোচর ছিল।
“এমন কঠিন পিতার ঔরসে জন্মিলেও তোমার অন্তঃকরণ অতি পবিত্র ও মহৎ। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, তুমি কেমন করে তোমার পিতার এই গভীর ষড়যন্ত্রের বিষয় অবগত হয়েছিলে? আর কি কৌশলেই বা তুমি রায়গড় পরিত্যাগ করে সেই নিবিড় বনরাজিপূর্ণ দুর্গম স্থানের সন্ধান পেলে?
তারাবাঈ ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া বলিলেন, “সেনাপতি! আপনাকে দর্শন করবার পর ত’তেই আমার প্রাণে ধীরে ধীরে আসক্তির তীব্র অনল প্রোজ্জ্বলিত হয়। তারপর আমাকে উন্মত্ত হস্তীর পদতল হ’তে ক্ষিপ্রতা এবং বীরত্ব ও কৌশলের সহিত রক্ষা করায়, আমি আপনার চরণেই আত্ম বিকিয়ে বসি। আমি সেই গভীর রজনীতে বিমনায়মান চিত্তে উদ্যানবাটিকায় বেড়াতে বেড়াতে উদ্যানমধ্যস্থ গৃহের নিকটবর্তী হয়ে বুঝতে পারলাম যে, গভীর নিশীথে সেই গৃহের দ্বার রুদ্ধ করে আমার পিতা, গুরু রামদাস স্বামী, মালোজী প্রমুখ কি যেন পরামর্শ করছেন।