শিবাজী অত্যন্ত সঙ্কুচিত হইয়া বলিলেন, “হায়! তাও কি হায়! আপনাকে পিছে রেখে আমি অগ্রে যাব, তা’ তখনও মনে করবেন না। আমা দ্বারা এরূপ বে-আদবী কখনও হবে না।”
আফজাল খাঁ হস্তী থামাইয়া শিবাজীকে অনেক পীড়াপীড়ি করিলেন; কিন্তু শিবাজী কিছুতেই অগ্রগমনে সম্মত হইলেন না। সুতরাং অগত্যা আফজাল খাঁই পূর্বের ন্যায় অগ্রগামী হইলেন। এক সঙ্কীর্ণ গিরিবর্ত্মের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া আফজাল খাঁ শিবাজীকে আবার অগ্রগমনের জন্য পীড়াপীড়ি করিলেন। শিবাজী পুনরায় অস্বীকৃত হইলেন। আফজাল খাঁ তখন সেইস্থলে হস্তী হইতে অবতরণপূর্বক সঙ্গী সৈন্যদিগকে আহবান করিয়া বলিলেন, “তোমরা কয়েক খন্ড গুরুভার প্রস্তর এই রাস্তার উপর দিয়ে সাবধানে সম্মুখের দিকে গড়িয়ে লয়ে যাও। এই রাস্তায় ঘোড়াডুবি-গর্ত আছে।”
তারাবাঈ ০৮ পরিচ্ছেদ
আফজাল খাঁর আদেশ মাত্রই কতিপয় সৈন্য দুইটি গুরুভার প্রস্তর গড়াইয়া কিয়দ্দূর লইয়া যাইতেই সহসা এক খন্ড প্রস্তর শ্যামল দুর্বাযুক্ত মৃত্তিকা ভেদ করিয়া ভীষণ শব্দে নিন্মে পতিত হইল। এই ভীষণ ও ভয়াবহ বিশ্বাসঘাতকতা দেখিয়া সকলেই শিহরিয়া উঠিল। আফজাল খাঁর সর্বনাশ সাধনের জন্যই যে, এই ভীষণ ষড়যন্ত্র করা হইয়াছে, তাই বুঝিতে কাহার ও আর বাকি থাকিল না। এই ভীষণ ষড়যন্ত্র লাইয়া বিশেষ আলোচনা হইবার পূর্বেই শিবাজী সহসা এক বংশীধ্বনি করিলেন। সেই বংশীধ্বনির সঙ্গে সঙ্গেই বহুসংখ্যক লুক্কায়িত মাওয়ালী সৈন্য, প্রতি প্রস্তর খন্ড, প্রতিবৃক্ষ ও প্রতি ঝোপের আড়াল হইতে নির্গত আক্রমণ চতুর্দ্দিক হইতে আফজাল খাঁ এবং তাঁহার মুষ্টিমেয় দেহরক্ষী সৈন্যকে ভীষণভাবে আক্রমণ করিল। অগণ্য হস্তী বা মহিষযুথ কর্তৃক আক্রান্ত হইলে সিংহ ভীষণ প্রদীপ্ত হওয়া উঠে, আফজাল খাঁ এবং তৎসঙ্গিগণও সেইরূপ রোষে-দুঃখে প্রোজ্জ্বলিত হুতাশন প্রায় নিতান্ত প্রদীপ্ত হইয়া ভীষণ তেজে উলঙ্গ কৃপাণ করে অরাতি নিধনে প্রমত্ত হইলেন। সন্ধ্যার তরল অন্ধকার তাঁহাদের কাফের-শোণিত-পিপাসু তরবারি বিদ্যুৎ চমন প্রদর্শন করিতে লাগিল। ত্রিশজন মোসলেম প্রায় দুই সহস্র শক্রর বিরুদ্ধে যুঝিতে লাগিল।
এই সঙ্কীর্ণ গিরিবর্ত্মের সম্মুখস্থ মাওয়ালী সৈন্যগণের ভিড় ঠেলিয়া এবং প্রচন্ড প্রহারে তাহাদিগকে তরল পারদের ন্যায় চঞ্চল করিয়া আফজাল খাঁ সেই গিরিপথের মধ্যে প্রবেশ করতঃ আত্মরক্ষা করিবার জন্য বিপুল চেষ্টা ও উদ্যোগ করিলেন।
আফজাল খাঁ এবং তাঁহার সৈন্যগণ কেহই বর্মপরিহিত ছিলেন না। সুতরাং শরীরের নানাস্থানে গুরুতর আঘাত প্রাপ্ত হইয়া সন্ত্রস্ত সিংহের ন্যায়, পবনাহত পাবকের ন্যায়, উন্মত্ত কুঞ্জরের ন্যায়, আহত ফণীর ন্যায়, সমুদ্রের তরঙ্গের ন্যায়, ভীষণ বাতাবর্তের ন্যায়, নিতান্ত উগ্র এবং একান্ত আত্মবিস্মৃত হইয়া তেজঃদৃপ্ত ও সংহারক হইয়া পড়িলেন! “দীন দীন” রবে ভীষণ গর্জন ও হুঙ্কার করিয়া শক্র বধ করিতে লাগিলেন। ভীষণ ও অসম যুদ্ধে দশজন মোসলেম বীরপুরুষ নিহত হইলেন। মারাঠীদিগের প্রায় অর্ধেক সৈন্য নিহত হইয়া ভূপতিত হইল। তথাপি রণে ভঙ্গ না দিয়া আফজাল খাঁকে নিহত বা বন্দী করিবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিতে লাগিল। ক্রমে সন্ধ্যার অন্ধকার বিচ্ছিন্ন করিয়া চন্দ্রের জ্যোৎস্নাজাল পৃথিবীকে আলোকিত করিয়া তুলিল। আফজাল খাঁ বিশ্বাসঘাতক ও বেইমান শিবাজীর প্রতি নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া প্রতিহিংসা সাধন মানসে, শক্রশ্রেণী ভেদ করিয়া তাঁহার প্রতি অভিদ্রুত হইলেন। কিন্তু আর উপায় নাই দেখিয়া সন্মান রক্ষার্থ মরিয়া হইয়া ভল্ল বিস্তারপূর্বক তেজের সহিত ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। বহুসংখ্যক মাওয়ালী ও মারাঠী যোদ্ধা আসিয়া আফজাল খাঁর ভীষণ আক্রমণ হইতে দস্যুপতি শিবাজীকে রক্ষা করিবার জন্য তাঁহাকে মন্ডলাকারে বেষ্টন করিয়া দাঁড়াইল। আফজাল খাঁকে লক্ষ্য করিয়া সকলেই ভীষণ বেগে বিষাক্ত শরজাল বর্ষণ করিতে লাগিল। কয়েকটি তীর আফজাল খাঁর স্কন্ধে এবং শরীরের নানাস্থানে বিদ্ধ হইলেও, পুরুষসিংহ তৎপ্রতি কিছুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করিয়া দুর্বিসহ পরাক্রমে শক্র হনন করিতে লাগিলেন। দুর্দ্দমতেজঃ প্রভাবে শিবাজীর দেহরী কতিপয় দস্যুযোদ্ধার মস্তক ছেদনপূর্বক শিবাজীর প্রতি মালেকল মউতের জিহবার ন্যায় ভয়াবহ রক্তরঞ্জিত তরবারি প্রসারণ করিয়া ধাবমান হইলেন। কিন্তু সহসা একটি বিষাক্ত তীর তাঁহার পেশানীতে বিদ্ধ হইল। রক্তধারায় মুহূর্তমধ্যে তাঁহার মুখমন্ডল এবং মনোহর শ্মাশ্রুরাশি আপ্লুত হইয়া গেল। যন্ত্রণায় তিনি অধীর ও বিপন্ন হইয়া পড়িলেন। শিবাজী এবং তাঁহার সঙ্গী যোদ্ধাগণ ভীষণভাবে প্রাণপণ করিয়া আফজাল খাঁকে আক্রমণ করিতে লাগিল।
আফজাল খাঁ সেইরূপ জখমী অবস্থাতেও দুর্জয় বাহুবলে কয়েকজন মারাঠী দস্যুকে নিধন করিয়া শিবাজীকে প্রচন্ড তরবারি প্রহার করিত উদ্যত হইলেন। কিন্তু বহু রক্তপাতে ও বিপুল পরিশ্রমে সহসা মূর্চ্ছিত প্রায় হইয়া ভূপতিত হইলেন।
সোলেমান খাঁ নামক জনৈক বীরপুরুষ অগ্রসর হইয়া আফজাল খাঁর দেহ রক্ষায় প্রবৃত্ত হইলেন। আফজাল খাঁকে ভূপতিত দেখিয়া শিবাজী এবং অন্যান্য দস্যুগণ তাঁহার শিরচ্ছেদ মানসে মাংস-লোলুপ শকুনির ন্যায় ছুটিয়া আসিল। সোলেমান খাঁ গুরুতরূপে আহত হইয়া শক্তির চরম বিন্দুতে নির্ভর করিয়া যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। কিন্তু আর রক্ষা করা অসম্ভব! মোসলেম সৈনিকগণ প্রায় সকলেই নিহত কিংবা গুরুতররূপে আহত হইয়া ভূতলশায়ী। যে দুইজন বাঁচিয়া আছে, তাহারাও বহুদূরে আফজাল খাঁ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছে। সাংঘাতিকরূপে আহত সোলেমান খাঁ মাথা আর ঠিক রাখিতে পারিতেছেন না! হস্ত শিথিল হইয়া আসিতেছে।