ওর বাবা আছেন? জিজ্ঞেস করলেন কেলারম্যান।
ধরে নিন এখন আমিই ওর বাবা।
এর মধ্যে লালমোহন হঠাৎ বলে উঠলেন, স্যার, ইন আওয়ার ফিলজফি, ত্যাগ ইজ মোর ইস্পার্ট্যান্ট দান ভোগ।
কথাটা বসাক কেলারম্যানকে অনুবাদ করে বুঝিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, মিস্টার তরফদার, আপনি কিন্তু একটা সুবর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করছেন না। এমন সুযোগ আপনি আর পাবেন না। ভেবে দেখুন।
বুঝতে পারলাম, ভদ্রলোক যদি নয়নকে কেলারম্যানের হাতে তুলে দিতে পারেন তা হলে তাঁর নিজের নির্ঘাত মোটারকম প্রাপ্তি আছে।
আমার ভাবা হয়ে গেছে, সহজ ভাবে বললেন তরফদার।
অগত্যা কেলারম্যানও উঠে দাঁড়ালেন। বসাক এবার পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বার করে তরফদারকে দিয়ে বললেন, এতে আমার নাম ঠিকানা ফোন নম্বর সবই আছে। যদি মাইন্ড চেঞ্জ করেন তো আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।
দুই ভদ্রলোককে দরজা অবধি পৌঁছে দিলেন তরফদার।
বসাক ঘুঘু লোক। তরফদার ফেরার পরে বলল ফেলুদা, নইলে মার্কিন ইমপ্রেসারিওর এজেন্ট সে হতে পারে না। পয়সার দিক দিয়েও সলিড, হয়তো কেলারম্যানের দৌলতেই। দামি ফরাসি আফটার-শেভ লোশন মেখে এসেছে—যদিও থুতনির নীচে এক চিলতে শেভিং সোপ এখনও লেগে আছে। বোঝাই যাচ্ছে ঘুম ভঙে দেরিতে, তাই নটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখতে তাড়াহুড়ো করতে হয়েছে।
০৪. পাংচুয়াল হলে
একজনকে তো বিদায় করা গেল, বললেন তরফদার, এবার দ্বিতীয় ব্যক্তির জন্য অপেক্ষা। পাংচুয়াল হলে তো আর দু-তিন মিনিটের মধ্যেই আসা উচিত।
দু মিনিট অপেক্ষা করতে হল না। নয়নকে ফেরত পাঠিয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গেই চাকরকে যেতে হল সদর দরজায়। সে ফিরে এল সঙ্গে একটি কালো সুট পরা ভদ্রলোককে নিয়ে। তরফদার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, গুড মর্নিং। আপনার নামটা টেলিফোনে ঠিক ধরতে পারিনি। আপনি যদি…
তেওয়ারি, সোফায় বসে বললেন ভদ্রলোক, দেবকীনন্দন তেওয়ারি। টি এইচ সিন্ডিকেটের নাম শুনেছেন?
তরফদার, জটায়ু দুজনেই চুপ দেখে ফেলুদাকেই মুখ খুলতে হল।
আপনাদের ইমপোর্ট-এক্সপোর্টের কারবার কি? পোলক স্ট্রিটে অপিস?
ইয়েস স্যার।
ভদ্রলোক ফেলুদার দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিলেন বলে তরফদার আমাদের বিষয় ওঁকে বলে দিলেন।
এরা আমার তিনজন বিশিষ্ট বন্ধু। আশা করি এঁদের সামনে কথা বলতে আপনার কোনও আপত্তি হবে না।
নো, নো। তবে কথা মানে শুধু একটি প্রশ্ন। ওই ছেলেটিকে যদি একবার আমার সামনে উপস্থিত করেন, তা হলে আমি তাকে কেবলমাত্র একটি প্রশ্ন করব। জবাব পেলে আমার অশেষ উপকার হবে, আর আমার কাজও শেষ হবে।
দেখিয়ে বললেন, ইনি তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবেন। দেখ। তার উত্তর দিতে পার কি না। তারপর তেওয়ারির দিকে ফিরে বললেন, আপনার প্রশ্নের উত্তর সংখ্যায় হবে। তো? অন্য কোনও প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এ দিতে পারবে না।
আই নো, আই নো। আমি জেনেশুনেই এসেছি।
তারপর—লালমোহমনবাবুর ভাষায়—নয়নের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিবন্ধ করে ভদ্রলোক বললেন, আমার সিন্দুকের কম্বিনেশনটা কী সেটা বলতে পার?
নয়ন ফ্যাল ফ্যাল করে ভদ্রলোকের দিকে চেয়ে আছে দেখে ফেলুদা বলল, শোনো জ্যোতিষ্ক—কম্বিনেশন জিনিসটা কী সেটা বোধহয় তুমি জান না। আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। একরকম সিন্দুক হয় যাতে তালাচাবি থাকে না। তার বদলে ডালার এক পাশে একটা চাকতি থাকে। যেটাকে ঘোরানো যায়। এই চাকতির গায়ে একটা তীর আঁকা থাকে, আর চাকৃতিটাকে ঘিরে সিন্দুকের গায়ে এক থেকে শূন্য অবধি নম্বর লেখা থাকে। কম্বিনেশন হল সিন্দুক খালার একটা বিশেষ নম্বর। চাকতিটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পর-পর সেই নম্বরের পাশে তীরটাকে আনলে শেষ নম্বরে পৌঁছতেই ঘড়াৎ করে সিন্দুক খুলে যায়—বুঝেছ?
বুঝেছি।
এখানে জটায়ু দুম করে একটা বেশ লাগসই প্রশ্ন করলেন তেওয়ারিকে।
আপনার নিজের সিন্দুকের কম্বিনেশন আপনি নিজেই জানেন না?
তেইশ বছর ধরে জেনে এসেছি, আক্ষেপের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললেন তেওয়ারি। স্বভাবতই মুখস্থ ছিল। ক হাজার বার সে সিন্দুক খুলেছি তার কি হিসাব আছে? কিন্তু বয়স যেই পঞ্চাশ পেরিয়েছে আমনি স্মৃতিশক্তি দুর্বল হতে শুরু করেছে। আজ চার দিন থেকে নম্বরটা কিছুতেই মনে পড়ছে না। একটা ডায়রিতে লেখা ছিল, বহু পুরনো ডায়রি—সেটা যে কোথায় গেছে। জানি না। আমি হয়রান হয়ে শেষে এই ছেলের খবর পেয়ে মিস্টার তরফদারের সঙ্গে অ্যাপায়েন্টমেন্ট করি।
আপনি কি আর-কাউকে কোনওদিন নম্বরটা বলেননি? আবার প্রশ্ন করলেন জটায়ু। ফেলুদার দিকে আড়াচাখে চেয়ে তার ঠোঁটের কোণে হাসি দেখে বুঝলাম সে জটায়ুকে তারিফ করছে।
তেওয়ারি বললেন, আমার ধারণা আমার পার্টনারকে বলেছিলাম—বহুকাল আগে অবশ্য-কিন্তু সে অস্বীকার করছে। হয়তো এও আমার স্মৃতিভ্ৰম। কম্বিনেশন তো আর পাঁচজনকে বলে বেড়াবার জিনিস নয়, আর এ-সিন্দুক হল আমার প্যাসোনাল সিন্দুক। আমার যে টাকা ব্যাঙ্কে নেই তা সবই এই সিন্দুকে আছে। অথচ…
তেওয়ারির দৃষ্টি সোফার পাশে দাঁড়ানো নয়নের দিকে ঘুরল। সঙ্গে সঙ্গে নয়ন বলল, সিক্স ফোর থ্রি এইট নাইন সিক্স ওয়ান।
রাইট! রাইট! রাইট! উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলেন তেওয়ারি। আর সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে একটা ছোট্ট নোটবুক বার করে ডটপেন দিয়ে তাতে নম্বরটা লিখে নিলেন।