তোমার সঙ্গে লেখাপড়া হয়ে গেছে?
আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি এখন অত্যন্ত হালকা বোধ করছি। নয়নের মাস্টার, ডাক্তার, জামাকাপড়—সব কিছুর খরচ উনি দিচ্ছেন। একটা প্রশ্ন অবিশ্যি উনি আমাকে করেন, সেটা হল কলকাতার বাইরে ভারতবর্ষের অন্য বড় শহরে শো করার অ্যামবিশান আমার আছে কি না। আমি জানাই যে সেদিনই সকলে আমি ম্যাড্রাস থেকে একটা টেলিফোন পেয়েছি মিঃ রেড্ডি নামে এক থিয়েটারের মালিকের কাছ থেকে। রবিবার রাত্রে আমার শো দেখে ভদ্রলোকের একজন কলকাতাবাসী সাউথ ইন্ডিয়ান বন্ধু রেডিকে নয়নের কথা টেলিফোনে জানান। তাই পরদিন সকালেই রেডি আমাকে ফোন করেন। খবরটা শুনে পৃষ্ঠপোষক জানতে চাইলেন আমি রেডিড়কে কী বলেছি। আমি বললাম-আমি ভাববার জন্য সময় চেয়েছি। তাতে পৃষ্ঠপোষক বলেন, তুমি এক্ষুনি রেডির আমন্ত্রণ অ্যাকসেপ্ট করছ বলে টেলিগ্রাম করে। দক্ষিণ ভারত সফরে যাবে তুমি। শুধু ম্যাড্রাস নয়, আরও অন্য শহরে শো করবে তুমি। সব খরচ আমার।
তোমাকে খরচের হিসাব দিতে হবে না? জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
তা তো বটেই, বললেন তরফদার। সে কাজের ভূগর নেবে। আমার ম্যানেজার ও বন্ধু শঙ্কর। ও খুব এফিশিয়েস্ট লোক।
পনেরো মিনিট যে চলে গেছে সেটা টের পেলাম যখন চাকর এসে বলল যে একটি সাহেব। আর তার সঙ্গে একটি বাঙালিবাবু এসেছেন।
এখানে নিয়ে এসো বললেন তরফদার।
জটায়ু দেখলাম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নড়েচড়ে বসলেন, কারণ এখন থেকে ফেলুদা নির্বাক।
সাহেবের মাথায় ধবধবে সাদা চুল হলেও বয়স যে বেশি না, সেটা চামড়ার টান ভাব দেখেই বোঝা যায়।
তরফদার উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, আগন্তুকদের বসতে বলে নিজেও বসলেন। ফেলুদা জায়গা করে দেবার জন্য আমাদের সোফাতেই লালমোহনবাবুর পাশে এসে বসল।
আমার নাম স্যাম কেলারম্যান, বললেন সাহেব। আর ইনি আমার ইন্ডিয়ার রিপ্রেজেনটিটিভ মিস্টার ব্যাস্যাক।
লালমোহনবাবু কাজে লেগে গেলেন।
ইউ আর অ্যান ইমপ্রেস্যোরিয়া-থুড়ি, ইমপ্রেসারিও?
ইয়েস। আজকাল ভারতীয় কালচার নিয়ে আমাদের দেশে খুব মাতামতি চলছে। মহাভারত নাটক হয়েছে, মুভিও হয়েছে, জানেন বোধহয়। তাতে ভারতীয় ঐতিহার একটা নতুন দিক খুলে গেছে।
সো ইউ আর ইনটারেস্টেড ইন ইন্ডিয়ান কালচার?
আই অ্যাম ইনটারেস্টেড ইন দ্যাট কিড।
ইউ মিন—সান অফ আ গোট?
আমি এটাই ভয় পেয়েছিলাম। আমেরিকানরা যে মানুষের বাচ্চাকেও কিড বলে সেটা লালমোহনবাবু জানেন না।
এবার মিঃ বসাক মুখ খুললেন।
ইনি জ্যোতিষ্কর কথা বললেন; মিঃ তরফদারের শো-তে যে ছেলেটি অ্যাপিয়ার করে। উনি ছেলেটি সম্বন্ধে কী জানতে চান সেটা বলবেন কি? বললেন তরফদার। মিঃ বসাক প্রশ্নটা অনুবাদ করে দেওয়াতে কেলারম্যান বললেন, আমি চাই এই আশ্চর্য ছেলেটিকে আমাদের দেশের দর্শকের সামনে হাজির করতে। এর যা ক্ষমতা তা ভারতবর্ষ ছাড়া কোনও দেশে সম্ভব হত না। অবিশ্যি কিছু স্থির করার আগে আমি একবার ছেলেটিকে দেখতে চাই, এবং তার ক্ষমতারও একটু নমুনা পেতে চাই।
বসাক বললেন, মিঃ কেলারম্যান পৃথিবীর তিনজন সবচেয়ে বিখ্যাত ইমপ্রেসারিওর একজন। একুশ বছর ধরে এই কাজ করছেন। ছেলেটিকে পাবার জন্য ইনি অনেক মূল্য দিতে প্ৰস্তুত। তা ছাড়া টিকিট বিক্রি থেকেও যা আসবে তার একটা অংশও ছেলেটি পাবে। সেটা চুক্তিতে লেখা থাকবে।
তরফদার বললেন, মিঃ কেলারম্যান, দ্য ওয়ান্ডার কিন্ড ইজ পার্ট অফ মাই ম্যাজিক শো। তার আমাকে ছেড়ে আর কোথাও যাবার প্রশ্নই উঠতে পারে না। সামনে আমার দক্ষিণ ভারত টুর আছে। –ম্যাড্রাস দিয়ে শুরু। সেখানে এই ছেলের খবর পৌঁছে গেছে, এবং তারা উদ্গ্ৰীব হয়ে আছে। এর অদ্ভুত ক্ষমতা দেখার জন্য। ভেরি সরি, মিঃ কেলারম্যান—আমি আপনার অনুরোধ রাখতে পারলাম না।
কেলারম্যানের মুখ লাল হয়ে গেছে। তাও তিনি ধরা গলায় অনুরোধ করলেন,ছেলেটিকে একবার দেখা যায়? আর সেই সঙ্গে যদি তার ক্ষমতার…?
তাতে অসুবিধে নেই। বললেন তরফদার। তার পর চাকরকে দিয়ে নয়নকে ডেকে পাঠালেন। নয়ন এসে তরফদারের সোফার হাতলে কনুই রেখে দাঁড়াল। দিনের বেলা তাকে এত কাছ থেকে দেখে অদ্ভুত লাগছিল। এমন একটা ক্ষমতা যে ওর মধ্যে আছে সেটা দেখে বোঝার কোনও উপায় নেই—যদিও চাউনিতে বুদ্ধির ছাপ স্পষ্ট।
কেলারম্যান অবাক হয়ে কিছুক্ষণ নয়নের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর মৃদুস্বরে, নয়নের দিক থেকে চোখ না। সরিয়ে বললেন, ও কি আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের নম্বর বলে দিতে পারে?
তরফদার বাংলায় নিয়নকে প্রশ্নটি করাতে সে বলল, কোন ব্যাঙ্ক? ওর তো তিনটে ব্যাঙ্কে টাকা আছে।
কেলারম্যানের মুখ থেকে লাল ভাবটা চলে গিয়ে ফ্যাকাশে ভাব দেখা দিল। সে ঢ়োক গিলে আগের মতোই ধরা গলায় মার্কিন নাকী উচ্চারণে বলল, সিটি ব্যাঙ্ক অফ নিউইয়র্ক।
বয়ন গড়গড় করে বলে দিল, ওয়ান টু ওয়ান টু এইট ড্যাশ সেভ্ন ফোর।
জিসাস ক্রাইস্ট!
কেলারম্যানের চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে।
আই অ্যাম অফারিং ইউ টোয়েন্টি থাউজ্যান্ড ডলারস ব্লাইট নাউ। তরফদারের দিকে ফিরে বলেন কেল্যারম্যান। তোমার ম্যাজিক শো থেকে কোনওদিন এত রোজগার করতে পারবে?
এ তো সবে শুরু, মিঃ কেলারম্যান, বললেন তরফদার। এখনও ভারতবর্ষের কত শহর পড়ে আছে; তারপর সারা পৃথিবীর বড় বড় শহর। ম্যাজিক দেখতে ছেলে-বুড়ো সকলেই ভালবাসে। আর এই ছেলেটি যে ম্যাজিক দেখায় তার নমুনা তো দেখলেন। আপনি। এর কোনও তুলনা আছে কি? বিশ হাজার কেন-তারও ঢের বেশি যে এ ছেলে আমার শো থেকে আনবে না, সেটা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারে?