কোথায় যাবে?
সাম অট্টালিকা।
সদর দরজার দারোয়ানও আমাদের সেলাম ঠুকে ভিতরে যেতে দিল।
আমরা যেখানে পৌঁছলাম, সেটা ল্যান্ডিং, বাঁয়ে সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে। এদিক ওদিক দেখছি, এমন সময় বেশ ভদ্র পোশাক পরা একজন চাকর-বেয়ারা বলাই বোধহয় ঠিক হবে—আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বলল, আসুন আপনারা। আমরা চাকরের পিছন পিছন গিয়ে বৈঠকখানায় হাজির হলাম।
বসুন; বাবু আসছেন।
এই ঘরের সাইজও মাঝারি, তবে আসবাবপত্রে বেশ রুচির পরিচয় আছে। দুটো সোফায় ভাগাভাগি করে আমরা তিনজন বসলাম।
গুড মর্নিং!
ম্যাজিশিয়ান হাজির, তবে একা নন। তাঁর পাশে একটি বিরাট অ্যালসেশিয়ান দণ্ডায়মান। আমি জানি ফেলুদা কুকুরের ভক্ত, আর যত বড় যত ভীতিজনক হাউন্ডই হোক না কেন, পোষা জানলে তার পিঠে হাত বোলানোর লোভ সামলাতে পারে না। এখানেও তাই করল।
এর নাম বাদশা, বললেন তরফদার। বয়স বারো। খুব ভাল ওয়াচ-ডগ।
এক্সেলেস্ট! আবার সোফায় বসে বলল ফেলুদা। আমরা কিন্তু তোমার কথামতো পনেরো মিনিট আগেই এসেছি।
আপনি যে পাংচুয়াল হবেন সেটা আমি জানতাম, তৃতীয় সোফায় বসে বললেন তরফদার।
তোমার এ বাড়ি কি ভাড়া বাড়ি? জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
আজ্ঞে না। এ বাড়ি আমার বাবার তৈরি। উনি নামকরা অ্যাটনি ছিলেন। আর একটা বাড়ি আছে-ওল্ড বালিগঞ্জ রোড়ে। সেটায় আমার দাদা থাকেন। দুই ভাইকে দুটো বাড়ি উইল করে দিয়ে যান। বাবা মারা যান এইট্রি-ফোরে। আমি এই বাড়িতেই মানুষ হয়েছি।
আপনি সংসার করেননি? জিজ্ঞেস করলেন জটায়ু।
আজ্ঞে না, মৃদু হেসে বললেন তরফদার। তাড়া কী? আগে শো-টাকে দাঁড় করাই।
চা এসে গেছে, সঙ্গে শিঙাড়া। ফেলুদা একটা শিঙাড়া তুলে নিয়ে বলল, আজ কিন্তু আমি শ্রোতা! কিছু বলার থাকলে ইনি বলবেন। ফেলুদা জটায়ুর দিকে নির্দেশ করল। ইনি কে জানি তো?
তা জানি বইকী? চোখ কপালে তুলে বললেন তরফদার। বাংলার নাম্বার ওয়ান রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক।
লালমোহনবাবু কোনও দিন চেষ্টা করেও বিনয়ী ভাব প্রকাশ করতে পারেননি; এখন একটা সেলুটে বুঝিয়ে দিলেন তিনি চেষ্টাই করছেন না।
ফেলুদা হাতের কাপ টেবিলে রেখে একটা চারমিনার ধরিয়ে বলল, তোমাকে একটা কথা অকপটে বলছি, সুনীল। তোমার শোয়ে শোম্যানশিপের কিঞ্চিৎ অভাব লক্ষ করলাম। আজকের উঠতি জাদুকরদের কিন্তু ও দিকটা নেগলেক্ট করলে চলে না। তোমার হিপূনটিজম, আর তোমার নয়ন—দুটোই আশ্চর্য আইটেম তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু আজকের দর্শক জাঁকজমকটাও চায়।
জানি। আমার মনে হয় সে অভাব। এবার পূরণ হবে। অ্যাদ্দিন যে হয়নি তার একমাত্র কারণ পুঁজির অভাব।
সে অভাব মিটাল কী করে? ভুরু তুলে প্রশ্ন করল ফেলুদা।
সুখবরটা দেবার মওকা খুঁজছিলাম। —আমি একজন ভাল পৃষ্ঠপাষক পেয়েছি, স্যার।
এই সেদিনই বলছিলাম, আর এর মধ্যেই…?
হ্যাঁ স্যার। আপাতত আর কোনও ভাবনা নেই।
কিন্তু কে সেই ব্যক্তি সে কি জানতে পারি?
কিছু মনে করবেন না, স্যার—তিনি তাঁর নামটা উহ্য রাখতে বলেছেন।
কিন্তু ব্যাপারটা ঘটল কী করে সেটা বলাও কি বারণ?
মোটেই না। এই ভদ্রলোকের এক নিকট-আত্মীয় গত রবিবার আমার শো দেখে সেই রাত্ৰেই ভদ্রলোককে নয়নের কথা বলেন। রাত দশটায়। ভদ্রলোকের কাছ থেকে আমি ফোন পাই। তিনি বলেন যে, অবিলম্বে আমার সঙ্গে একবার দেখা করতে চান। আমি পর দিনই সকাল দশটায় সময় দিই। উনি কটায় কাঁটায় দশটায় এসে হাজির হন। তার পর বৈঠকখানায় এসে বসে আমাকে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করেন জ্যোতিষ্ককে কীভাবে দেখা যায়। নয়ন আমার কাছেই থাকে জেনে ভদ্রলোক তৎক্ষণাৎ নয়নকে ডেকে পাঠাতে বলেন। নয়ন এলে পর ভদ্রলোক তাকে দু-একটা এমন প্রশ্ন করেন যার উত্তর সংখ্যায় হয়। নয়ন অবশ্যই ঠিক ঠিক জবাব দেয়। ভদ্রলোক হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ নয়নের দিকে চেয়ে থেকে নিজেকে
কী প্রস্তাব?
প্ৰস্তাবটা আমাকে হাতে চাঁদ পাইয়ে দিল। উনি বললেন আমার শোয়ের সব খরচ উনি বহন করবেন। একটা কোম্পানি স্থাপন করবেন যার নাম হবে মিরাকলস আনলিমিটেড। এই কোম্পানির মালিক কে তা কেউ জানবে না। এই কোম্পানির হয়েই আমি শো করব। তা থেকে খ্যাতি যা হবে তা আমার, খরচ হয়ে লাভ যা হবে তা ওঁর। আমাকে উনি মাসোহারা দেবেন যাতে আমার আর নয়নের স্বচ্ছন্দে চলে যায়। ..আমি অবিশ্যি এ প্রস্তাবে রাজি হই, কারণ আমার মন থেকে সমস্ত চিন্তা দূর হয়ে যাচ্ছে এতে।
কিন্তু এমন সুযোগ উনি হঠাৎ কেন দেবেন। সে কথা জিজ্ঞেস করনি?
স্বভাবতই করেছি, এবং উনি তাতে এক অদ্ভুত কাহিনী শোনালেন। ওনার শখ ছিল পেশাদারি জাদুকর হবেন। ইস্কুল থেকে শুরু করে বাইশ বছর বয়স পর্যন্ত উনি সমানে ম্যাজিক অভ্যাস করেছেন, ম্যাজিকের বই আর সরঞ্জাম সংগ্রহ করেছেন। বাদ সাবলেন। ওঁর বাবা। তিনি ছেলের এই নেশা সম্বন্ধে কিছুই জানতেন না। একদিন ঘটনাচক্ৰে জানতে পেরে রেগে আগুন হয়ে ছেলের ম্যাজিকের সব সরঞ্জাম ছুড়ে ফেলে দিয়ে জোর করে তাকে ব্যবসায় নামান। অসম্ভব কড়া মেজাজের লোক ছিলেন বাবা, তাই ছেলে তাঁর শাসন মেনে নেন। শুধু তাই নয়, অল্পদিনের মধ্যেই তিনি ভাল রোজগার করতে শুরু করেন। তা সত্ত্বেও তিনি ম্যাজিকের মোহ কাটিয়ে উঠতে পারেন না। ভদ্রলোক বললেন, আমি রোজগার করেছি। অনেক কিন্তু তাতে আমার আত্মার তৃপ্তি হয়নি। এই ছেলেকে দেখে বুঝতে পারছি এই আমার জীবনে সার্থকতা এনে দেবে।