মাধ্যমিক, বলল ছেলেটা। তরফদার জ্যোতিষ্কর দিকে ফিরে বললেন, এই ছেলেটি মাধ্যমিক পরীক্ষায় বাংলায় কত নম্বর পেয়েছে বলতে পার?
জ্যোতিষ্ক বলল, একাশি। ওর চেয়ে বেশি কেউ পায়নি।
উত্তর শুনে ছেলেটি নিজেই হাততালি দিয়ে উঠল।
শোয়ের পর ফেলুদা বলল, এক বার ব্যাকস্টেজে যাওয়া দরকার। তরফদারকে একটা ধন্যবাদ তো দিতেই হয়।
আমরা গেলাম। তরফদার আয়নার সামনে বসে মেক-আপ তুলছেন—আমাদের দেখেই এক-গাল হেসে উঠে দাঁড়ালেন।
কেমন লাগল ফ্র্যাঙ্কলি বলুন, স্যার।
দুটো আইটেমের তারিফ করতেই হয়, বলল ফেলুদা। এক, আপনার হিপ্নটিজম, আর দুই–জ্যোতিষ্ক। কোথেকে পেলেন এই আশ্চর্য ছেলেকে?
কালীঘাটের ছেলে। ওর আসল নাম নয়ন; জ্যোতিষ্ক নামটা আমিই দিয়েছি; বিজ্ঞাপনেও জ্যোতিষ্কই ব্যবহার করছি। কথাটা আপনাদের বললুম, আপনারা কাইন্ডলি আর কাউকে বলবেন না।
না না, বলল ফেলুদা। কিন্তু শুধু কালীঘাট বললে তো কিছুই বলা হল না।
বাপ অসীম সরকার থাকেন নিকুঞ্জবিহারী লেনে! ছেলের আশ্চর্য ক্ষমতা দেখে আমার কাছে নিয়ে আসেন। যদি আমি ওকে কাজে লাগাতে পারি। আসলে ভদ্রলোক অভাবী, তাই ভাবলেন ছেলেকে দিয়ে যদি কিছু একস্ট্রা ইনকাম হয়।
সেটা যে হবে সে বিষয় আমার কোনও সন্দেহ নেই, ছেলেটি কি বাপের কাছেই থাকে?
আজ্ঞে না। আমি ওকে নিজের বাড়িতে এনে রেখেছি! ওর পড়াশুনোর জন্য টিউটর ঠিক করেছি; কাল এক ডাক্তারকে ডেকেছিলাম, উনি নয়নের ডায়েট বাতলে দিয়েছেন।
এ সব তো রীতিমতো খরচের ব্যাপার!
জানি স্যার। তবে এও জানি যে, নিয়ন ইজ এ গোলন্ডমাইন। ওর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যদি ধার-দেনাও করতে হয়, সে টাকা ক’দিনের মধ্যে উঠে আসবে।
হুঁ…তবে আইডিয়াল হত যদি আপনি একটি পৃষ্ঠপোষক জোগাড় করতে পারতেন।
সেটা আমিও বুঝি স্যার। দেখি আর দুটো দিন…
আপনার অনেকটা সময় নিয়েছি। আর মাত্র দুটো কথা বলে আপনাকে রেহাই দেব। এক—এই স্বর্ণখনিটি যাতে বেহাত না হয়, সেদিকে আপনার কড়া নজর রাখতে হবে। সেকেন্ড রো-তে মনে হল। কয়েকজন সাংবাদিককে দেখলাম, তাই না?
ঠিক দেখেছেন, স্যার। এগারোজন সাংবাদিক আজকে আমার শো দেখেছেন। তারা সকলেই আগামী শুক্রবারের সিনেমার পাতায় আমার শোয়ের বিষয় লিখবেন। ইতিমধ্যে কোনও চিন্তার কারণ আছে বলে মনে হয় না।
যাই হোক, এটা বলে গেলাম যে, যদি নয়ন সম্বন্ধে কোনও এনকোয়ারি বা টেলিফোন আসে যা আপনার মনে খটকা জাগায়, তা হলে আমাকে জানাতে দ্বিধা করবেন না।
মেনি থ্যাঙ্কস, স্যার। এবার আমার একটা রিকোয়েস্ট আছে।
কী?
এবার থেকে আমায় আপনি না বলে তুমি বলবেন কাইন্ডলি।
০৩. শুক্রবারের কাগজ
শুক্রবারের কাগজে নয়ন সম্বন্ধে বেরোনোর কথা; আজ মঙ্গলবার। বেশ অবাক হলাম দেখে যে, আজই তরফদারের কাছ থেকে টেলিফোন এল। শুধু ফেলুদার দিকটা শুনে ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারলাম না; ফোন রাখার পর ফেলুদা খুলে বলল।
খবরটা এর মধ্যেই ছড়িয়েছে, বুঝেছিস তোপ্সে। আটশো লোক সেদিন ম্যাজিক দেখেছে; তার মধ্যে কতজন কত লোককে নয়ন সম্বন্ধে বলেছে কে, জানে? ব্যাপারটা যা দাঁড়িয়েছে—তরফদার চারজনের কাছ থেকে টেলিফোন পেয়েছে! হেঁজিপোঁজি নয়, বেশ মালদার লোক। তারা সকলেই নয়ন সম্বন্ধে কথা বলতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট চায়। তরফদার কাল সকাল নটা থেকে অ্যাপিয়েন্টমেন্ট রেখেছে। প্রত্যেককে পনেরো মিনিট সময় দেবে। এও বলে দিয়েছে যে, তার সঙ্গে আরও তিনজন লোক থাকবে—অর্থাৎ মিস্টার ফেলু, মিস্টার তপেশ আর মিস্টার লালু। এই খবরটা তুই এক্ষুনি ফোন করে জটায়ুকে জানিয়ে দে।
কিন্তু এই চারজন করা, সেটা তরফদার বললেন না?
একজন আমেরিকান, একজন পশ্চিমা ব্যবসাদার, একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, একজন বাঙালি। আমেরিকানটি নাকি ইমপ্রেসারিও। অৰ্থাৎ নানা রকম শিল্পীদের স্টেজে উপস্থিত করেন এবং তা থেকে দু পয়সা কামান। অন্য তিনজন কী তা গেলে জানা যাবে। আসল কথা যা বুঝলাম–তরফদার বুঝেছে সে একা সিচুয়েশনটা হ্যান্ডল করতে পারবে না; তাই আমাদের ডাকা।
লালমোহনবাবুকে ফোন করাতে ভদ্রলোক আর থাকতে না পেরে চলেই এলেন। শ্ৰীনাথ! বলে একটা হাঁক দিয়ে তাঁর প্রিয় কাউচটাতে বসে বললেন, একটা চেনা-চেনা গন্ধ পাচ্ছি যে মশাই, কী ব্যাপার?
এখন পর্যন্ত গন্ধ পাবার কোনও কারণ নেই, লালমোহনবাবু। এটা নিছক আপনার কল্পনা।
আমি মশাই কাল থেকে ওই খোকার কথা ভাবছি। কী অদ্ভুত ক্ষমতা বলুন তো! কিছুই বলা যায় না, বলল ফেলুদা, এক দিন হয়তো দেখবেন হঠাৎ ম্যাজিকের মতো ক্ষমতাটা লোপ পেয়ে গেছে। তখন আর-পাঁচটা ছেলের সঙ্গে নয়নের কোনও তফাত থাকবে না।
কাল তা হলে আমরা তরফদারের ওখানে মিট করছি?
ইয়েস, এবং একটা কথা আপনাকে বলে রাখি—আমি কিন্তু কাল গোয়েন্দা হিসেবে যাচ্ছি। না। আমি হব নির্বাক দর্শক। যা কথা বলার তা আপনি বলবেন।
এটা আপনি রিয়েলি মিন করছেন?
সম্পূর্ণ।
ঠিক হ্যায়। জয় মা তারা বলে লেগে পড়ব।
*
একডালিয়া রোডে তরফদারের বাড়ি। মাঝারি দোতলা বাড়ি—অন্তত পঞ্চাশ বছরের পুরনো তো বটেই। গেটে সশস্ত্ৰ দারোয়ান; বুঝলাম ফেলুদার সতর্কবাণীতে ফল হয়েছে।
ফেলুদার নাম শুনে দারোয়ান গেট খুলে দিল, আমরা ভিতরে ঢুকলাম।
ঢুকেই ডাইনে এক ফালি বাগান, তাতে কেয়ারির কোনও বালাই নেই। সদর দরজার দিকে এগিয়ে যাবার সময় ফেলুদা দাঁতের ফাঁক দিয়ে বলল, দেখবি উইদিন টু ইয়ারস তরফদার এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।