আমার অপরাধটা কী, সেটা জানতে পারি?
নিশ্চয়ই। এক, তুমি হত্যাকারী ; দুই, তুমি চোর। সে কথাই আমি পুলিশকে বোঝাব।
আপনি পাগল হয়ে গেছেন। আপনি প্ৰলাপ বকছেন।
মোটেই না। হিঙ্গোয়ানি চেনা লোক ছাড়া আর কারুর জন্য দরজা খুলবেন না এটা তিনি নিজেই বলেছিলেন। যাকে আমরা এতক্ষণ খুনি বলে ভাবছিলাম।–অর্থাৎ কচ্ছদেশীয় সেই গোয়েন্দা-তাকে হিঙ্গোয়ানি চিনতেন না। সেই কারণেই গোয়েন্দা হিঙ্গোয়ানির ছবি সঙ্গে এনেছিলেন, যাতে তিনি শিওর হতে পারেন যে ঠিক লোকের সঙ্গেই তিনি দেখা করছেন। অতএব তার জন্য দরজা খুলে দেওয়া হিঙ্গোয়ানির পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তোমায় তিনি চিনতেন ভাল করেই, তাই তুমি নিজের পরিচয় দিলে তাঁর পক্ষে দরজা খুলে দেওয়া স্বাভাবিক।
আপনি একটা কথা ভুলে যাচ্ছেন, ফেলুবাবু,। পুলিশ পরিষ্কার বলেই দিয়েছে হিঙ্গোয়ানি তার আততায়ীকে বাধা দেবার কোনও চেষ্টা করেননি ; দেয়ার ওয়জ নো সাইন অফ স্ট্রগুলি! আমি যদি ছুরি বার করে তাঁর দিকে এগিয়ে যেতাম, তিনি কি বাধা দেবার চেষ্টা করতেন না?
একটা বিশেষ ক্ষেত্রে কখনই করতেন না।
কী সেই বিশেষ ক্ষেত্ৰ?
সেটা তোমারই ক্ষেত্র, তরফদার। সম্মোহন। হিঙ্গোয়ানিকে হিপ্নোটাইজ করে খুন। করলে তিনি বাধা দেবেন কী করে?
আপনার পাগলামি এখনও যায়নি, ফেলুবাবু! হিঙ্গোয়ানি আমার অন্নদাতা। তাঁর ব্যাকিং-এর উপর আমার সমস্ত ভবিষ্যৎ নির্ভর করছিল। আমি কি এমনই মূৰ্থ যে একেই খুন করব? যার শিল, যার নোড়া, তারই ভাঙি দাঁতের গোড়া? আপনি হাস্যালেন মিঃ মিত্তির–আপনি হাসালেন–
এই বেলা হেসে নাও, চমকদার তরফদার; এর পরে আর সে অবস্থা থাকবে না।
আপনি কি ইঙ্গিত করছেন যে আমার প্রধান অবলম্বন নয়ন চলে গিয়ে আমি কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে খুন করেছি?
না, কারণ তোমার জবানিতেই জানা যায় যে নয়ন সন্ধ্যাবেলা নিখোঁজ হয়, আর হিঙ্গোয়ানির মৃত্যুর সময় দুপুর আড়াইটে থেকে সাড়ে তিনটের মধ্যে।
আপনি এখনও উলটোপালটা বলছেন, মিঃ মিত্তির। মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করুন।
আমার মাথায় জল ঢালো, তরফদার-দেখবে তা বরফ হয়ে গেছে। … এবারে একটা খবর তোমাকে দিই। আমি কিছুক্ষণ আগে নীচে বইয়ের দোকানটায় গিয়েছিলাম। যিনি দোকানে বসেন সেই মহিলার সঙ্গে আমার কথা হয়। তিনি বলেন গত চার দিনের মধ্যে তাঁর বইয়ের দোকান থেকে কোনও ছোটদের বই বিক্রি হয়নি, এবং কোনও খদ্দেরের সঙ্গে কোনও ছোট ছেলে আসেনি।
শিং-শি মাস্ট বি লাইং!
নো, সুনীল তরফদার–নট শি। মিথ্যাবাদী হচ্ছে তুমি এবং তোমার ম্যানেজার শঙ্কর হুবলিকার। শঙ্করের মাথায় পোর্সিলেনের ছাইদান দিয়ে বাড়ি মেরেছি বলে হয়তো তার মধ্যে কিছুটা চেতনার সঞ্চার হবে–কিন্তু তোমার ঢ্যাঁটামো দেখছি কিছুতেই যাচ্ছে না।
শঙ্করকে আপনিই বেহুঁশ করেছেন?
ইয়েস, সুনীল তরফদার।
কেন?
কারণ সে খুনের কারণ গোপন রাখতে সাহায্য করছিল।
দরজায় বেল বেজে উঠল।
তোপ্সে, মিঃ রামচন্দ্রনকে ভেতরে নিয়ে আয়।
দরজা খুলতে রামচন্দ্রন ঢুকে এসে ফেলুদার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দিলেন।
ফেলুদা কিছু বলার আগেই তরফদার রামচন্দ্রনের দিকে ফিরে চেঁচিয়ে উঠলেন, এই ব্যক্তি বলছেন। আমি খুন করেছি, কিন্তু কোনও কারণ বা মোটিভ দেখাতে পারছেন না।
ফেলুদা সঙ্গে সঙ্গে বলল, শুধু খুন নয়, তরফদার। ভুলো না—ডাকাতিও বটে। হিঙ্গোয়ানির প্রতিটি কপর্দক এখন তোমার হাতে। পাঁচ লাখের উপর–যেটা দিয়ে তুমি নিজের পৃষ্ঠপোষকতা নিজেই করার মতলব করেছিলে।
ফেলুদা এবার আমার দিকে ফিরল।
তোপ্সে–বাথরুমের ভিতরে যে রয়েছে, তাকে বার করে আন তো।
আমি বাথরুমের দরজা খুলে অবাক হয়ে দেখি, নয়ন দাঁড়িয়ে আছে। এবার সে বেরিয়ে ফেলুদার দিকে এগিয়ে গেল।
শঙ্কর একে তার বাথরুমের মধ্যে বন্ধ করে রেখেছিল। আসল ঘটনাটা আমার চোখের সামনে ফুটে উঠতে আমি শঙ্করের ঘরে যাই, এবং তাকে অজ্ঞান করে নয়নকে নিয়ে আসি। নয়নের মুখ থেকেই শোনো তোমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সন্ত্রাস এবং তোমার খুন ও চুরির রাস্তা নেবার কারণ।
তরফদারের দিকে চেয়ে দেখলাম তাঁর সর্বাঙ্গে কাঁপুনি ধরেছে।
নয়ন, বলল ফেলুদা, তরফদার মশাইকে ক বছর জেল খাটতে হবে বলো তো।
তা তো জানি না।
জান না।
কেন, নয়ন? কেন জান না?
আমি তো চোখের সামনে আর নম্বর দেখছি না।
দেখছ না?
না। তোমাকে তো বললাম। –সব নম্বর পালিয়ে গেছে।