তা হলে ধরে নিন যে হিঙ্গোয়ানির সঙ্গে এই গোয়েন্দার আলাপ ছিল, এবং হিঙ্গোয়ানি তাকে অসৎ লোক বলে জানতেন না।
কিন্তু সেই লোক যখন ছুরি বার করবে। তখন হিঙ্গোয়ানি বাধা দেবেন না? ষ্ট্রাগল হবে না?
আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হয়। কী ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব সেটা আপনি ভেবে বের করবেন। যদি না পারেন, তা হলে বুঝতে হবে আপনার পাঠকদের অভিযোগের যথেষ্ট কারণ আছে। কোথায় গেল। আপনার আগের সেই জৌলুস? সেই ক্ষুরধার—
চুপ!
লালমোহনবাবুকে ব্রেক কষতে হল।
ফেলুদা আমাদের দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে এখন দেয়ালের দিকে চেয়ে-চোখে সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি, কপালে গভীর খাঁজ।
আমি আর জটায়ু প্ৰায় এক মিনিট কথা বন্ধ করে ফেলুদার এই নতুন চেহারাটা দেখলাম। তারপর আমাদের কানে এল কতকগুলো কথা-ফিসফিসিয়ে বলা–
বু-ঝে-ছি! -কিন্তু কেন, কেন, কেন?
দশ-বারো সেকেন্ড নৈঃশব্দের পর লালমোহনবাবুর চাপা কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
আপনি একটু একা থাকতে চাইছেন কি?
থ্যাঙ্ক ইউ, মিস্টার গাঙ্গুলী। আধঘণ্টা, আধঘণ্টা একা থাকতে চাই।
আমরা দুজনে উঠে পড়লাম।
১৪. কফি শপে গিয়ে চা খাওয়া
আমার মনে যে ইচ্ছেটা ছিল, সেটা দেখলাম লালমোহনবাবুর ইচ্ছের সঙ্গে মিলে গেছে। সেটা হল নীচে কফি শপে গিয়ে চা খাওয়া।
আমরা কফি শাপে গিয়ে একটা টেবিল দখল করে বসে চায়ের অর্ডার দিলাম। সঙ্গে স্যান্ডউইচ হলে মন্দ হত না, বললেন জটায়ু। শুধু চা বড় চট করে ফুরিয়ে যাবে। আধ ঘণ্টা কাটাতে হবে তো! বেয়ারা দাঁড়িয়েছিল; চায়ের সঙ্গে দু প্লেট চিকেন স্যান্ডউইচ যোগ করে দিলাম।
আসার আগে আঁচ পেয়েছি যে ফেলুদা আলোর সন্ধান পেয়েছে; সেটা কম কি বেশি। জানি না, কিন্তু বুঝতে পারছি যে শিরদাঁড়া দিয়ে ঘন ঘন শিহরন বয়ে যাচ্ছে।
হাতে সময় আছে। তাই লালমোহনবাবু তাঁর সবে-মাথায়-আসা উপন্যাসের আইডিয়াটা শোনালেন। যথারীতি গল্পের নাম আগেই ঠিক হয়ে গেছে। মাথুরিয়ায় রোমাঞ্চ। বললেন, চায়ন সম্বন্ধে একটু পড়ে নিতে হবে। অবিশ্যি আমার এ গল্পে আজকের চিনের চেহারা পাওয়া যাবে না; এ হবে ম্যান্ডারিনদের আমলের চায়না।
খাওয়া শেষ, লালমোহনবাবুর গল্প শেষ, তাও দেখি দশ মিনিট সময় রয়েছে।
কফি শপ থেকে লবিতে বেরিয়ে এসে জটায়ু বললেন, কী করা যায়, বলে তো!
আমি বললাম, আমার ইচ্ছে করছে একবার বুক শপটাতে ঢুঁ মারি। ওটা তো এখন আমাদের কাছে একটা হিস্টোরিক জায়গা-নয়ন তো ওখান থেকেই অদৃশ্য হয়েছে।
গুড আইডিয়া। আর বলা যায় না-হয়তো গিয়ে দেখব। আমার বই ডিসপ্লে করা:
হয়েছে।
ইডলি দোসার দেশে আপনার বই থাকবে না, লালমোহনবাবু।
দেখি না খোঁজ করে!
দোকানের ভদ্রমহিলার বয়স বেশি না, আর দেখতেও সুশ্ৰী! জটায়ু এক্সকিউজ মি বলে ভদ্রমহিলার দিকে এগিয়ে গেলেন।
ইয়েস স্যার?
ডু ইউ হ্যাভ ক্রাইম নভেলস ফর-ইয়ে, কী বলে-কিশোরস?
কিশোরস? ভদ্রমহিলার ভুরু কুঁচকে গেছে।
ফর ইয়াং পিপল, বললাম আমি।
ইন হোয়াট ল্যাংগুয়েজ?
বাংলি-আই মিন, বেঙ্গলি।
নো, স্যার। নো বেঙ্গলি বুকস। স্যরি। বাট উই হ্যাভ লট্স অফ চিলড্রেনস্ বুকস ইন ইংলিশ।
জানি। আই নো।
তার পর একটু হেসে ফাস্ট গিয়ার দিয়ে আরম্ভ করলেন, টুডে-মানে, দিস আফটারনুন, এ ফ্রেন্ড…ইয়ে…নু
বুঝলাম সেকেন্ড গিয়ারে গাড়ি আটকে গেছে। আমাকেই বলে দিতে হল যে, আজই বিকেলে আমাদের এক বন্ধু এই দোকান থেকে দুটো ইংরিজি চিলড্রেনস বুক্স কিনে নিয়ে গেছে।
দিস আফটারনুন?
ইয়েস? বললেন জটায়ু। নো?
নো, স্যার।
নো।
ভদ্রমহিলা বললেন। গত চার দিনের মধ্যে কোনও ছোটদের বই তিনি বিক্রি করেননি। আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। আমার বুকে ধুকপুকুনি। ধরা গলায় বললাম, দশ মিনিট হয়ে গেছে, লালমোহনবাবু।
ভদ্রমহিলাকে একটা থ্যাঙ্ক ইউ জানিয়ে আমরা প্রায় দৌড়ে গিয়ে লিফটে উঠলাম। বোতাম টিপে খসখসে গলায় জটায়ু বললেন, এ যে বিচিত্র সংবাদ।
আমি কোনও উত্তর দিলাম না, কারণ আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না।
চাবি ঘুরিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢুকে দুজনেই একসঙ্গে কথা বলে ফেললাম।
ও মশাই-!
ফেলুদা!
ওয়ান অ্যাট এ টাইম—ফেলুদার গলায় ধমকের সুর।
আমি বললাম, আমি বলছি। —শঙ্করবাবু বইয়ের দোকানে যাননি।
টাট্কা কিছু থাকে তো বল। এটা বাসি খবর।
আপনি জানেন?
আমি সময়ের অপব্যবহার করি না, লালমোহনবাবু। বইয়ের দোকানে প্রায় বিশ মিনিট আগেই হয়ে এসেছি। মিস স্বামীনাথনের সঙ্গে কথা বলেছি। খবরটা আপনাদের দিতে গিয়ে দেখলাম, আপনারা গোগ্রাসে স্যান্ডউইচ গিলছেন; তাই চলে এলাম।
কিন্তু তা হলো–? আমার অসমাপ্ত প্রশ্ন।
তরফদার আসছে। এক্ষুনি ফোন করেছিল। বেশ উত্তেজিত বলে মনে হল। দেখি কী বলে।
দরজায় ঘণ্টা।
তরফদার, মুখ চুন।
আমায় বাঁচান, ফেলুবাবু! হাহাকার করে উঠলেন ভদ্রলোক!
কী হল?
শঙ্কর। ওর ঘরে গোস্লাম। বেহঁশ হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। আমার বিপদের কি আর শেষ নেই?
ফেলুদার কাছ থেকে এই প্রশ্নের এক অদ্ভুত উত্তর এল।
না, সুনীল তরফদার; এই সবে শুরু।
মানে? চেরা গলায় বলে উঠলেন তরফদার।
মানে অত্যন্ত সহজ, সুনীল। তুমি এখনও নিরপরাধের পোশাক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছ; এ পোশাক তোমাকে মানায় না, সুনীল। তুমি যে ঘোর অপরাধী!
মিস্টার মিত্তির, আমাকে এই ধরনের কথা বলার কোনও অধিকার নেই আপনার।
কী বলছি সুনীল? গোয়েন্দা অপরাধীকে ধরে ফেললে তার উপর দোষারোপ করবে না? তুমি এই যে এলে আমার ঘরে, এখান থেকে সোজা চলে যাবে পুলিশের হাতে। তারা পাঁচ মিনিটের মধ্যেই এসে পড়বে।