কিন্তু হিঙ্গোয়ানি হঠাৎ টাকা চুরি করবে। কেন?
কারণ ওর পকেট ফাঁক হয়ে আসছিল, গলা সপ্তমে তুলে বললেন আগন্তুক। শেষ বয়সে জুয়ার নেশা ধরেছিল! প্রতি মাসে একবার করে কাঠমাণ্ডু যেত। ওখানে জুয়ার আড়ত ক্যাসিনো আছে জানেন তো? সেই ক্যাসিনোতে গিয়ে হাজার হাজার টাকা খুইয়েছে রুলেটে। তেওয়ারি ব্যাপারটা জেনে যায়। হিঙ্গোয়ানিকে অ্যাডভাইস দিতে যায়। হিঙ্গোয়ানি খেপে ওঠে। এমন দশা হয়েছিল। লোকটার যে, বাড়ির দামি জিনিসপত্র বেচিতে শুরু করে। শেষে মরিয়া হয়ে পার্টনারের সিন্দুকের দিকে চোখ দেয়।
আপনি কী করবেন স্থির করেছেন।
তোমাদের এখান থেকে আমি তার ঘরেই যাব। আমার বিশ্বাস, চুরির টাকা তার সঙ্গেই আছে। তেওয়ারি কেমন মানুষ, জানেন?–সে বলেছে, তার টাকা ফেরত পেলে সে তার পুরনো পার্টনারের বিরুদ্ধে কোনও স্টেপ নেবে না। এই খবরটা আমি হিঙ্গোয়ানিকে জানাব-তাতে যদি তার চেতনা হয়।
আর যদি না হয়?
ভদ্রলোক সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে সেটাকে অ্যাশট্রেতে পিষে ফেলে একটা ক্রুর
হাসি হেসে বললেন, সে ক্ষেত্রে অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।
আপনি গোয়েন্দা হয়ে আ-আইন-বিরুদ্ধ কাজ—?
ইয়েস, মিস্টার মিটার! গোয়েন্দা শুধু এক রকমই হয় না, নানা রকম হয়। আমি অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করি। এটা কি আপনি জানেন না যে, গোয়েন্দা আর ক্রিমিন্যালে প্রভেদ সামান্যই?
ভদ্রলোক উঠে পড়লেন। আবার জটায়ুর সঙ্গে জবরদস্ত হ্যান্ডশেক করে—গ্ল্যান্ড ঢুঁ মিট ইউ, মিস্টার মিটার। গুড ডে। বলে গাটগটিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
আমরা তিনজন কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। ফেলুদাই প্রথম কথা বলল।
থ্যাঙ্ক ইউ, লালমোহনবাবু। মীন থাকার সুবিধে হচ্ছে যে, চিন্তার আরও বেশি সময় পাওয়া যায়। কোনও একটা ব্যারামে—হয়তো ডায়াবেটিস—হিঙ্গোয়ানি রোগ হয়ে যাচ্ছিলেন। তাই সেদিন বারবার কবজি থেকে ঘড়ি নেমে যাওয়া, আর চুরির সময় আঙুল থেকে আংটি খুলে যাওয়া।
আপনি কি তা হলে ওই গোয়েন্দার কথা বিশ্বাস করছেন?
করছি, লালমোহনবাবু, করছি। অনেক ব্যাপার, যা ধোঁয়াটে লাগছিল, তা ওর কথায় স্পষ্ট হয়ে গেছে। তবে হিঙ্গোয়ানি টাকা চুরি করে অর্থাভাব মেটানোর জন্য নয়; সে কাঠমাণ্ডুতে জুয়া খেলে যতই টাকা খুইয়ে থাকুক, নয়নকে পেয়ে সে বোঝে, তার সব সমস্যা মিটে যাবে। সে টাকা চুরি করে মিরাকলস আনলিমিটেড কোম্পানিকে দাঁড় করানোর জন্য, তরফদারকে ব্যাক করার জন্য।
তা হলে এখন আপনি হিঙ্গোয়ানির সঙ্গে দেখা করবেন না?
তার তো কোনও প্রয়োজন নেই! যিনি দেখা করবেন। তিনি হলেন ডিটেকনিকের এই গোয়েন্দা। হিঙ্গোয়ানিকে তেওয়ারির টাকা বাধ্য হয়েই এই গোয়েন্দার হাতে তুলে দিতে হবে-প্রাণের ভয়ে। কাজেই তরফদারের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তার আর কোনও ভবিষ্যৎ নেই।
তা হলে এখন…?
এইখানেই দাঁড়ি দিন, লালমোহনবাবু। এর পরে যে কী, তা আমি নিজেই জানি না।
১২. সমুদ্রের ধারে
জটায়ু আর আমার পিছনে যেহেতু কেউ লাগেনি, বিকেলে আমরা দুজনে সমুদ্রের ধারে গেলাম হাওয়া খেতে; হিঙ্গোয়ানির কপালে কী আছে জানি না, তবে এটা মনে হচ্ছে যে, নয়নের আর কোনও বিপদ নেই। যদি তেওয়ারির টাকা ফেরত দিয়েও হিঙ্গোয়ানির কাছে বেশ কিছু টাকা অবশিষ্ট থাকে, তা হলে তরফদারের শো হতে কোনও বাধা নেই। আর প্রথম শো থেকেই তো টিকিট বিক্রির টাকার অংশ আসতে শুরু করবে। মনে হয় হিঙ্গোয়ানি এখনও বেশ কিছু দিন চালিয়ে যাবেন।
জটায়ুকে বলতে তিনি চোখ রাঙিয়ে বললেন, তপশ, আই অ্যাম শকড়। লোকটা একটা ক্রিমিনাল, পরের সিন্দুক থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়েছে, আর সে লোক নয়নকে ভাঙিয়ে খাবে, এটা ভেবে তুমি খুশি হচ্ছে?
খুশি নয়, লালমোহনবাবু। হিঙ্গোয়ানির বিরুদ্ধে যা প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাতে তো তাকে এই মুহূর্তে জেলে পোরা যায়। কিন্তু তার পার্টনার যদি পুরনো বন্ধুত্বের খাতিরে তার উপর দয়াপরবশ হয়ে তাকে রেহাই দেন-তাতে আমার-আপনার কী বলার আছে?
লোকটা জুয়াড়ি—সেটা ভুলো না। আমার অন্তত কোনও সিমপ্যাথি নেই হিঙ্গোয়ানির উপর।
তেষ্টা পাচ্ছিল দুজনেরই। লালমোহনবাবু কোল্ড কফি খাবার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। এখানকার কফিটা একটা প্লাস পয়েন্ট সেটা স্বীকার করতেই হবে।
সমুদ্রের কাছেই একটা কাফে আবিষ্কার করে আমরা একটা টেবিল দখল করে বেয়ারাকে কোন্ড কফি আড়ার দিলাম। কাফেতে অনেক লোক, বুঝলাম। এদের ব্যবসা ভালই চলে।
মিনিটখানেকের মধ্যে ঠকঠক করে দুটো গেলাস এসে পড়ল আমাদের টেবিলের উপর। আমরা দুজনেই ঘাড় নিচু করে প্লাস্টিকের স্ট্রয়ের ডগা ঠোঁটের মধ্যে পুরে দিলাম।
হ্যাভ ইউ টোল্ড ইয়োর টিকটিকি ফ্রেন্ড?
লালমোহনবাবু একটা বিশ্ৰী শব্দ করে বিষম খেলেন।
মুখ তুলেই দেখি টেবিলের উলটাদিকে চকুরা-বকরা হাওয়াইয়ান শার্ট পরে দণ্ডায়মান মিস্টার নন্দলাল বসাক।
লালমোহনবাবু সামলে নিতে ভদ্রলোক বললেন, শুধু এইটে বলে দেবেন। মিত্তিরকে এবং তরফদারকে যে, নন্দ বসাক পায়ের তলায় ঘাস গজাতে দেয় না। পাঁচিশে ডিসেম্বর যদি শো হয়, তা হলে সেই শো থেকে শেষের আইটেমটি বাদ যাবে, এ গ্যারান্টি আমি দিতে পারি।
আমাদের পাশেই কাফের দরজা। ভদ্রলোক কথাটা বলেই সে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বাইরে অন্ধকার, তাই তিনি যে কোনদিকে গেলেন সেটা বুঝতেই পারলাম না।