ফেলুদা সরাসরি লালমোহনবাবুর দিকে দেখিয়ে বলল, দিস ইজ মিস্টার মিটার।
ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে দিলেন লালমোহনবাবুর দিকে। জটায়ু দেখলাম নিজেকে সামলে নিয়েছেন, আর বেশ ভাটের সঙ্গেই হ্যান্ডশেকটা করলেন। মনে পড়ল ফেলুদাই একবার জটায়ুকে বলেছিল—হ্যান্ডশেকটা পুরোপুরি সাহেবি ব্যাপার, তাই ওটা করতে হলে সাহেবি মেজাজেই করবেন, মিনমিনে বাঙালি মেজাজে নয়; মনে রাখবেন-গোরুখোরের গ্রিপ আর মাছখোরের গ্রিপ এক জিনিস নয়।
মনে হয় সেটা মনে রেখেই জটায়ু বেশ শক্ত করে আগস্তুকের হাতটা ধরে দু বার সারা শরীর দুলিয়ে ঝাঁকুনি দিয়ে হাতটা টেনে নিয়ে বললেন, সিট ডাউন, মিস্টার–
ভদ্রলোক একটা সোফায় বসে বললেন, আমার নাম বললে আপনারা চিনবেন না? আমি এসেছি মিঃ তেওয়ারির কাছ থেকে। ওঁর সঙ্গে আমার বহু দিনের আলাপ! এ ছাড়া আমার আর একটা পরিচয় আছে। –আমিও আপনারই মতো একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। আমার কোম্পানির নাম ছিল ডিটেকনিক। সাতাশ বছর আগে কলকাতায় এই কোম্পানি স্টার্ট করে। নাইনটিন সিক্সটি এইটে—আজি থেকে বাইশ বছর আগে-আমি বম্বে চলে যাই আমার কোম্পানি নিয়ে। তাই আপনার নাম শুনলেও আপনার চেহারার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। আই অ্যাম সারপ্রাইজড়—কারণ আপনার চেহারা দেখে গোয়েন্দা বলে মনেই হয় না। কিছু মনে করবেন না, মিস্টার মিটার, বাট ইউ লুক ভেরি অর্ডিনারি। বরং এঁকে–
আগন্তুক ফেলুদার দিকে দৃষ্টি ঘোরালেন। জটায়ু গলাটা রীতিমতো চড়িয়ে বললেন, হি ইজ মাই ফ্রেন্ড মিস্টার লালমোহান গ্যাঙ্গুলী, পাওয়ারফুলি আউটস্ট্যান্ডিং রাইটার।
আই, সি।
আপনি কোথাকার লোক?
ভদ্রলোক যা বললেন, তাতে ছাগলের গলায় খাঁড়ার কোপ পড়ার মতো শব্দ হল।
কচ্।
কচ্ছ?
ইয়েস.যাই হোক, যে কারণে আসা…
ভদ্রলোক কোটের পকেট থেকে একটা পোস্টকার্ড সাইজের ফোটা বার করে জটায়ুর দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি খুব যে কাছে ছিলাম, তা নয়, কিন্তু তাও বুঝতে পারলাম সেটা হিঙ্গোয়ানির ছবি। ।
এই লোকের হয়ে আপনি কাজ করছেন প্রোফেশনালি, তাই না?
ফেলুদা নির্বিকার। জটায়ুর চোখ এক মুহূর্তের জন্য কপালে উঠে নেমে এল। আমাদের ধারণা ফেলুদা যে হিঙ্গোয়ানির হয়ে কাজ করছে সেটা বাইরের কেউ জানে না। ইনি জানলেন কী করে?
তাই যদি হয়, বললেন আগন্তুক, তা হলে আমি আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী। কারণ, আমি তেওয়ারির দিকটা দেখছি। ওর ব্যাপারটা আমি কাগজে পড়ে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করি। বাইশ বছর পরে আমার হদিস পেয়ে সে আনন্দে লাফিয়ে ওঠে। কলকাতায় থাকতে আমি ওকে অনেক ব্যাপারে হেলপ করি, সেটা ও ভোলেনি। বলল—আই নিড় ইওর হেল্প এগেন। –আমি রাজি হই, আর তক্ষুনি কাজে লেগে যাই। প্রথমেই হিঙ্গোয়ানির বাড়িতে ফোন করে জানতে পারি, ও কলকাতায় নেই। ওর এক ভাইপো ফোন ধরেছিল; বলল-আঙ্কল কোথায় যাচ্ছেন তা বলে যাননি। –আমি এয়ারলাইনসে খোঁজ করে ম্যাড্রাসের প্যাসেঞ্জার লিস্টে ওর নাম পাই। বুঝতে পারি, তেওয়ারির শাসনির ফলে সে ভয়ে চম্পট দিয়েছে। এর পর আমি ওর বাড়িতে যাই। ওর বেয়ারার কাছে জানতে পারি যে ক’দিন আগে তিনজন বাঙালি হিঙ্গোয়ানির সঙ্গে দেখা করতে আসেন, তাদের একজনের নাম মিত্তর। আমার সন্দেহ হয়। আমি ডাইরেক্টরি থেকে আপনার নম্বর বার করে ফোন করি। একজন সার্ভেন্ট ফোন ধরে বলে যে, আপনি ম্যাড্রাস গেছেন। আমি দুয়ে দুয়ে চার হিসেব করে ম্যাড্রাস যাওয়া স্থির করি। কাল এখানে এসেই ফোনে সব হোটেলে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, হিঙ্গোয়ানি করোমণ্ডলে আছেন। আমি জিজ্ঞেস করি। -মিটার বলে আছেন। কেউ?–উত্তর পাই, হ্যাঁ আছেন; পি. মিটার। তখনই স্থির করি, আপনার সঙ্গে দেখা করে লেটেস্ট সিচুয়েশনটা জানাব। এটা আপনি স্বীকার করছেন তো যে, হিঙ্গোয়ানি আপনাকে অ্যাপিয়েন্ট করেছে তাকে প্রোটেক্ট করার জন্য?
এনি। অবজেকশন?
মোনি।
আমরা তিনজনেই চুপ। ফেলুদা কিন্তু মাঝে মাঝে সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়ার রিং ছাড়ছে, দেখে বোঝার কোনও উপায় নেই তার মনে কী আছে।
তেওয়ারির সিন্দুকের ঘটনা এখন কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে, জানেন? বললেন আগন্তুক।
কলকাতার কাগজে বেরিয়েছে কি? জটায়ুর প্রশ্ন।
ইয়েস। সম্পূর্ণ নতুন তথ্য। এতে কেসটার চেহারাটাই পালটে যায়। কাগজ পড়েই আমি তেওয়ারির সঙ্গে যোগাযোগ করি। আপনি যাঁর প্রাণরক্ষার ভার নিয়েছেন তিনি কেমন লোক জানেন? হি ইজ এ থিফ, স্কাউণ্ডেল অ্যান্ড নাম্বার ওয়ান লায়ার।
ভদ্রলোক শেষের কথাগুলো বললেন ঘর কাঁপিয়ে। জটায়ু প্ৰাণপণ চেষ্টা করেও তাঁর কথায় আতঙ্কের রেশ ঢাকতে পারলেন না।
হা-হাউ ঢু ইউ নোহে?
তার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। হিঙ্গোয়ানি তেওয়ারির সিন্দুক থেকে পাঁচ লক্ষের উপর টাকা চুরি করেছে। সিন্দুকের তলা থেকে হিঙ্গোয়ানির আংটি পাওয়া গেছে-পালা বসানো সোনার আংটি। ওর আপিসের প্রত্যেকে ওই আংটি চিনেছে। আংটিটিা গড়িয়ে একেবারে পিছন দিকে চলে গিয়েছিল। তাই এতদিন বেরোয়নি। পরশু বেয়ার মেঝে সাফ করতে গিয়ে পায়। এটাই হচ্ছে আমার রঙের তুরুপ। দিস উইল ফিনিশ হিঙ্গোয়ানি।
কিন্তু যখন চুরিটা হয় তখন তো হিঙ্গেরাজ-থুড়ি, হিঙ্গোয়ানি-আপিসে ছিলেন না।
ননসেন্স গৰ্জিয়ে উঠলেন ডিটেকটিভ। হিঙ্গোয়ানি চুরিটা করে মাঝরাত্তিরে, আপিস টাইমে নয়। গোয়েঙ্কা বিল্ডিং-এ টি এইচ সিন্ডিকেটের আপিস। সেই বিল্ডিং-এর দারোয়ানকে পাঁচশো টাকা ঘুষ দিয়ে হিঙ্গোয়ানি আপিসে ঢেকে রাত দুটোয়। এ কথা দারোয়ান পুলিশের দাবিড়ানিতে স্বীকার করেছে। সিন্দুকের কম্বিনেশন তেওয়ারি হিঙ্গোয়ানিকে বলেছিল, সেটা তেওয়ারির এখন পরিষ্কার মনে পড়েছে। প্ৰায় বছর পনেরো আগে তেওয়ারির জনডিস হয়, হাসপাতালে ছিল, খুব খারাপ অবস্থা। হিঙ্গোয়ানি তখন তার পার্টনার আর ঘনিষ্ঠ বন্ধু! বন্ধুকে ডেকে তেওয়ারি বলে, আমি মরে গেলে আমার সিন্দুক কী করে খোলা হবে? হিঙ্গোয়নি ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু তেওয়ারি জোর করে তাকে নম্বরটা নোট করে নিতে বলে। হিঙ্গোয়ানি সে অনুরোধ রাখে।