দৈত্যটার বেয়াল্লিশটা দাঁত।
১১. করোমণ্ডলের মোগলাই
বেশ জমিয়ে লাঞ্চ খাওয়া হচ্ছে করোমণ্ডলের মোগলাই ডাইনিং রুম মাইসোরে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার হল-আজকের খানার পুরো ভার নিয়েছেন লালমোহনবাবু। আসলে তরফদার যে সম্মোহনের জোরে ওঁর প্রাণ বাঁচিয়েছিল, তাতে-ওঁরই ভাষায়—উনি সবিশেষ কৃতজ্ঞ।
খেতে খেতে ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন, অনেক খ্রিলিং ঘটনার মধ্যে পড়িচি মশাই–থ্যাঙ্কস টু ইউ-কিন্তু আজকেরটা একেবারে ফাইভ-স্টার অভিজ্ঞতা।
দানবের বগলবন্দি হওয়াটা কীভাবে ঘটল, সেটা ফেলুদা আগেই জিজ্ঞেস করেছিল। আর লালমোহনবাবু সেটা বলেওছিলেন। তাঁর ভাষাতেই ঘটনার বর্ণনাটা এখানে দিচ্ছি।
আর বলবেন না, মশাই-আমি তো খোকাকে গপ্পো শোনাতে মশগুল, গুহায় ঢুকছি। আর বেরোচ্ছি, পল্লব-টল্লব মাথা থেকে হাওয়া হয়ে গেছে। একটা গুহায় ঢুকে দেখলুম সামনেই মহিষাসুর। বেরিয়ে আসব, এমন সময় দেখলুম-আরেকটা মূর্তি রয়েছে যেটা বিশাল, বীভৎস। এটার চোখ বোজা, আর মিশকালো রঙের উপর লাল-সাদা ডোরা। মনে মনে ভাবছি—এই ব্যতিক্রমের কারণটা কী?—এও ভাবছি—একি ঘটাৎকচের মূর্তি নাকি?–কারণ মহাভারতের অনেক কিছুই তো এখানে দেখছি। এমন সময় মূর্তিটা চোখ খুলল। ভাবতে পারেন?—ধূমসোটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমোচ্ছিল!
চোখ খুলেই অবশ্য আর এক মুহূর্ত দেরি করল না। আমি আর নয়ন দুজনেই ব্যোমকে গেছি, সেই অবস্থাতেই আমাদের দুজনকে বগলদাবা করে নিয়ে দে ছুট!
ফেলুদা মন্তব্য করেছিল যে বোঝাই যাচ্ছে গাওয়াঙ্গির মনটা খুব সরল। এমনকী এও হতে পারে যে, তার বুদ্ধি বলে কিছু নেই; যা আছে সে শুধু শারীরিক বল। না হলে সুনীল তাকে হিপনোটাইজ করতে পারত না।
তরফদার আর শঙ্করবাবু কোথায় গিয়েছিলেন জিজ্ঞেস করাতে তরফদার বললেন, শঙ্করের হবি হচ্ছে আয়ুৰ্বেদ। ও শুনেছিল যে, মহাবলীপুরমে সর্পগন্ধা গাছ পাওয়া যায়, তাই আমরা দুজনে খুঁজতে গিয়েছিলাম। গাছ পেয়ে ফিরতি পথে দেখি এই কাণ্ড। সৰ্পগন্ধা তো ব্লাড প্রেশারে কাজ দেয়, তাই না? বলল ফেলুদা! হ্যাঁ বললেন শঙ্করবাবু! এই সুনীলের প্রেশার মাঝে মাঝে চড়ে যায়। ওর জন্যই এই গাছ আনা।
এর পরেই জটায়ু প্রস্তাব করেন যে তিনি সকলকে খাওয়াবেন। মোগলাই খানার কথাও উনিই বলেন, আর তাতে সকলেই রাজি হয়।
এখন একটুকরো চিকেন টিক্কা কাবাব মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে ভদ্রলোক ফেলুদার দিকে মুচুকি হেসে বললেন, আপনার প্রয়োজনীয়তা যে ফুরিয়ে গেছে, সেটা আজ প্রমাণ হল।
ফেলুদা ঠাট্টাটাকে খুব একটা আমল না দিয়ে বলল, তার চেয়েও বড় কথা হলি-গাওয়াঙ্গি বাতিল হয়ে গেল।
ইয়েস, বললেন জটায়ু। এখন বাকি শুধু মিস্টার ব্যাস্যাক।
আমাদের সঙ্গে আজ মিঃ রেডিও খাচ্ছেন-অবিশ্যি নিরামিষ। পরশু বড়দিনে তাঁর রোহিণী থিয়েটারে তরফদারের শো শুরু। বিজ্ঞাপনের ব্যাপারে রেডি যে কোনও কার্পণ্য করেননি, সেটা ফেরার পথে রাস্তার দু পাশে তামিল আর ইংরেজি পোস্টার দেখেই বুঝেছি। প্রত্যেকটাতেই জাদুকরের পোশাক পরে তরফদারের ছবি আর সেই সঙ্গে জ্যোতিষ্কম্–ওয়ান্ডার বয়-এর নাম। রেড্ডি জানালেন যে, এর মধ্যেই প্রথম দু দিন হাউসফুল হয়ে গেছে।
আমি বলছি আজ আর কোথাও বেরোবেন না, বললেন মিঃ রেডি। আর কালকের দিনটাও রেস্ট করুন। আপনাদের আজকের এক্সপিরিয়েন্স তো শুনলাম; ওই ছেলেকে নিয়ে আর কোনও রিস্ক নেবেন না। ওর কিছু হলে যারা টিকিট কেটেছে, তারা সবাই টাকা ফেরত চাইবে। তখন কী দশা হবে ভেবে দেখুন। –আমারও, আপনারও। থিয়েটারে অবিশ্যি আমি পুলিশ রাখছি, কাজেই শো-এর সময় কোনও গণ্ডগোল হবে না।
গাওয়াঙ্গির ঘটনার ফলে তরফদার আর শঙ্করবাবু দুজনেই বুঝেছেন যে, নয়নকে সামলানোর ব্যাপারে কোনও গাফিলতি চলবে না। ফেলুদা ওদের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলল, মহাবলীপুরম দেখে ওর মাথা ঘুরে গিয়েছিল—না হলে আমি কখনওই মিস্টার গাঙ্গুলীর হাতে নয়নকে ছাড়াতাম না। এখন শিক্ষা হয়েছে, এবার থেকে আর কোনও গণ্ডগোল হবে না।
জটায়ুর গল্প শেষ। তাই নয়ন আজ খাবার পরে তরফদারের সঙ্গে ঘরে চলে গেল।
এখনও যে চমকের শেষ সীমায় পৌঁছইনি, সেটা ঘরে ফেরার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই-অর্থাৎ আড়াইটে নাগাত–প্রমাণ হল।
ফেলুদা আজ রগড়ের মুডে ছিল। জটায়ুকে বলেছিল—এবার থেকে আপনিই সামাল দিন, আমার দিন তো ফুরিয়ে এল-ইত্যাদি। লালমোহনবাবু ব্যাপারটা রীতিমতো উপভোগ করছিলেন, এমন সময় টেলিফোনটা বেজে উঠল। ফেলুদা মিনিটখানেক ইংরেজিতে কথা বলে ফোনটা রেখে বলল, চিনলাম না। কিছুক্ষণের জন্য আসতে চায়।
আসতে বললে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
হ্যাঁ, বলল ফেলুদা। হোটেলে এসেছে, নীচ থেকে ফোন করল। জটায়ু–প্লিজ টেক ওভার।
মানে? লালমোহনবাবুর মুখ হ্যাঁ।
আমার প্রয়োজনীয়তা তো ফুরিয়েই গেছে। দেখাই যাক না আপনাকে দিয়ে চলে কি না।
লালমোহনবাবু কিছু বলার আগেই দরজার বেল বেজে উঠল।
আমি দরজা খুলতে একজন মাঝারি হাইটের বছর-পঞ্চাশের ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। মাথার চুল পাতলা এবং সাদা হয়ে এসেছে, তবে গোঁফটা কালো এবং ঘন। ভদ্রলোক এক বার জটায়ু আর এক বার ফেলুদার দিকে চেয়ে ইংরিজিতে বললেন, আপনার নামের সঙ্গে আমি পরিচিত, মিঃ মিটার, কিন্তু আপনার চেহারার সঙ্গে নয়। হুইচ ওয়ান অফ ইউ ইজ–?