ফেলুদার আদেশ, তাই পঞ্চপাণ্ডব গুহায় খানিকটা সময় দিলাম। একটা ঘাড়-ফেরানো গোরু আর তার পাশে দাঁড়ানো বাছুরের দৃশ্য দেখে মনে হল যে, ঠিক এই দৃশ্য আজও বাংলার যে কোনও গ্রামে দেখা যায়। শুধু গোরু বাছুর কেন, মহাবলীপুরমের হাতি হরিণ বাঁদর ষাঁড় ইত্যাদি দেখে বুঝতে পারি তেরশো বছরেও এদের চেহারার কোনও পরিবর্তন হয়নি। অথচ পোশাক বদলের জন্য সে যুগের মানুষকে আজ আর চেনার কোনও উপায় নেই।
গুহা থেকে বেরিয়ে কয়েকটা পরিবর্তন লক্ষ করলাম, যেগুলো কানে আর চোখে ধরা পড়ল।
এক, সূর্য ঢেকে গেছে ছাই রঙের মেঘে। গুডগুড়ুনি যে মেঘের ডাক তাতে কোনও সন্দেহ নেই। রোদের তেজটা চলে গিয়ে এখন সমুদ্রের হাওয়াটা আরও বেশি টের পাওয়া যাচ্ছে।
সবচেয়ে বেশি তফাত ধরা পড়ে কানে। সমুদ্রের দীর্ঘশ্বাস ছাড়া চারিদিকে কোনও শব্দ নেই; আমি গুহাতে পাঁচ মিনিটের বেশি থাকিনি। সামনে মহিষমৰ্দিনী গুহা। তার ভিতর থেকে লালমোহনবাবুর গলা পাওয়া উচিত। কারণ গল্পের বেশ জমাট অংশে তিনি গুহায় পৌঁছেছিলেন। অবিশ্যি তিনি গুহাতে না-চুকেই এগিয়ে গিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু কেন? ও দিকে তো আর কিছু দেখার নেই! কোথায় গেলেন ভদ্রলোক নয়নকে নিয়ে?
কেমন যেন একটা সংশয়ের ভাব আমাকে চেপে ধরল। আমি দেখলাম, মহিষমৰ্দিনী গুহার দিকে আমি দৌড়তে শুরু করেছি।
গুহার পাশে পৌঁছতেই আরেকটা শব্দ আমার আতঙ্ক সপ্তামে চড়িয়ে দিল।
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ—
টি এন টি-র হাসি!
উর্ধশ্বাসে সামনে ছুটে গিয়ে মোড় ঘুরে একটা সাংঘাতিক দৃশ্য দেখে আমার নিশ্বাস মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়ে গেল।
দেখলাম, একটা লাল-সাদা ডুরে-কাটা জামা আর কালো প্যান্ট পরা এক অতিকায় কৃষ্ণকায় প্রাণী-যাকে দানব বললে খুব ভুল হয় না-এক-বগলে জটায়ু আর অন্য বগলে নয়নকে নিয়ে দ্রুত পা ফেলে ক্ৰমে দূরে সরে যাচ্ছে।
ভয়াবহ দৃশ্য, কিন্তু তখন আমার মাথায় খুন চেপে গেছে, আর তার ফলে শরীরে এনার্জি আর মনে সাহস এসে গেছে। আমি ফেলুদা! বলে একটা চিৎকার দিয়ে প্রাণপণে ছুটে গেলাম দানবটার দিকে-আমার উদ্দেশ্য পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার একটা পা জাপটে ধরে তার হাঁটা বন্ধ করব।
কিন্তু যা ভেবেছিলাম সেটা করেও কোনও ফল হল না। পা জড়িয়ে ধরতেই প্রথমে দানবটা একটি বিকট চিৎকার দিল-বুঝলাম, যেখানে বাদশা কামড়েছিল ঠিক সেখানেই আমি চাপ দিয়েছি। তার পরমুহূর্তে দেখলাম সেই জখম পায়ের ঝটিকানিতে আমি মাটি থেকে শূন্যে উঠে গেছি। তার পর চোখের পলকে দেখি, আমি নয়নের সঙ্গে একই বগলের নীচে বন্দি হয়ে হাওয়া কেটে এগিয়ে চলেছি, আমার পা দুটো পেণ্ডুলামের মতো দুলছে দৈত্যটার মাংসপেশির চাপে আমার নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে এলেও আমি শুনতে পাচ্ছি। অন্য বগলের তলা থেকে লালমোহনবাবুর মাগো! মাগো! আর্তনাদ।
আর হাসি?
সামনে বিশ হাত দূরে তারকনাথ হাসতে হাসতে লাফাচ্ছেন আর ডান হাত মাথার উপর তুলে লাঠি ঘোরাচ্ছেন।
কেমন? গাওয়াঙ্গি কাকে বলে, দেখলে? তারস্বরে প্রশ্ন করলেন টি এন টি।
কিন্তু এখন তো আর তিনি একা নেই! তাঁর পিছন থেকে এগিয়ে এসে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন দুজন লোক। তার মধ্যে একজন অদ্ভুতভাবে সামনে ঝুঁকে পড়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে বকের মতো এগিয়ে আসছেন আমাদের দিকে।
চমকদার স্যুনাল তরফদার।
এবার তরফদার তাঁর গতি না কমিয়ে হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে সাপের ফণার মতো দালাতে লাগলেন—তাঁর বিস্ফারিত দৃষ্টি সটান আমাদের যিনি বগলদাবা করেছেন তাঁর দিকে।
এই চাউনি, এই ঝুঁকে পড়া, হাতের এই ঢেউ খেলানো-এ সবই আমার চেনা। এ হল তরফদারের সম্মোহনের কায়দা।
তারকনাথ হঠাৎ উন্মাদের মতো লাঠি উচিয়ে তরফদারের দিকে ধাওয়া করতেই পিছন থেকে এক লাফে এগিয়ে এসে শঙ্করবাবু বুড়োর হাত থেকে লাঠিটা ছিনিয়ে নিলেন।
এবার বুঝলাম আমাদের গতি কমে আসছে।
আকাশে আবার মেঘের গর্জন।
তারকনাথ এবার দু হাতে নিজের মাথার চুল টেনে ধরে ঘড়িঘড়ে গলায় একটা অদ্ভুত অচেনা ভাষায় গাওয়াঙ্গিকে কী যেন বললেন।
গাওয়াঙ্গি আর তরফদার এখন মুখোমুখি।
আমি বগলদাবা অবস্থাতেই কোনওরকমে ঘাড় ঘুরিয়ে গাওয়াঙ্গির মুখের দিকে চাইলাম। এমন মুখ আমি আর দেখিনি। চোয়াল ঝুলে পড়ে দাঁত বেরিয়ে গেছে, আর চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে।
বগলদাবা করা বিশাল হাত দুটো এবার ধীরে ধীরে নেমে এল; আমার পা এখন টিতে। ও দিকে লালমোহনবাবুও মাটিতে।
আপনারা গাড়িতে গিয়ে উঠুন! চোখের পাতা না ফেলে গাওয়াঙ্গির দিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে চেঁচিয়ে বললেন তরফদার। আমরা এক্ষুনি আসছি?
উলটা দিকে দৌড় দেবার আগের মুহূর্তে দেখলাম, তারকনাথ মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়লেন।
ফেলুদা এখনও গঙ্গাবতরণের সামনে দাঁড়িয়ে। আমাদের তিনজনকে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে আসতে দেখে যেন ও আপনা থেকেই ব্যাপারটা আঁচ করে নিল।
আমাদেরও আগে ও দৌড়ে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিল। আমরা চারজন হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়লাম।
টার্ন ব্যাক্! টার্ন ব্যাক চেঁচিয়ে আদেশ দিল ফেলুদা। এই ড্রাইভার হিন্দি জানে না; কেবল তামিল আর ভাঙা ভাঙা ইংরিাজি।
গাড়ি উলটামুখো হতেই ফেলুদা আবার বলল, নাউ ব্যাক টু ম্যাড্রাস-ফাস্ট!
গাড়ি বিদ্যুদ্বেগে রওনা দেবার পর শুধু একজনই কথা বলল। সে হল নয়ন।