যেমন লখাইপুরের সেই জোড়া খুনের মামলা?
তা তো বটেই। সেটাতে তো তোপ্সেকে আমার ধারে-পাশেই আসতে দিইনি—যদিও সে এখন আর খোকাটি নেই, এবং বয়সের তুলনায় অনেক বেশি জানে-বোঝে।
তার মানে আপনি বলতে চান যে, তোপ্সের বাছাইয়ে গলদ রয়েছে?
সেটা হত না যদি না ও প্রকাশকের তাগিদের চোটে বিভ্ৰান্ত হয়ে পড়ন্ত। ওকে দোষ দিই। কী করে বলুন? আমার মামলা থেকে ও যা খাড়া করে তাকে কিশোর উপন্যাসই বলা হয়ে থাকে। এইসব উপন্যাস যদি শুধু কিশোররাই পড়ত, তা হলে কিন্তু কোনও সমস্যা ছিল না; আসলে যেটা ঘটে সেটা হল, কিশোরদের সঙ্গে তাদের মা, বাবা, মাসি, পিসি, খুড়ো, জ্যাঠা সকলেই এসব উপন্যাস পড়ে। একসঙ্গে এত স্তরে চাহিদা মেটানো কি চাট্টিখানি কথা?
আপনি তপেশকে একটু গাইড করুন না। সেটা করব। আগে করতাম, ইদানীং করি না। আবার করব। তবে তার আগে প্রকাশকের সঙ্গে একটা মোকাবিলা করা দরকার। তাদের বোঝাতে হবে যে, লাগসই মামলা পেলেই তারা উপন্যাস পাবে, নচেৎ নয়। তাতে যদি একটা বছর ফেলুদা বাদও যায়, সেটাও। তাদের মেনে নিতে হবে। তারা ঘোর ব্যবসাদার; আমার মান-ইজত নিয়ে তারা চিন্তিত নয়—সে চিন্তা আমাদেরই করতে হবে।
পাঠকদের সঙ্গেও তো একটা মোকাবিলার প্রয়োজন, তাই নয় কি? এই যে সব যারা রাগী-রাগী চিঠি দিল?
এরা বোকা নয়, লালমোহনবাবু। এদের চাহিদা অত্যন্ত সঙ্গত। সেটা মেটাতে পারলেই এরা আবার আমাকে তুলে ধরবে।
শুধু আপনাকে? আমাকে নয়?
একশোবার! আপনি-আমি তো পরস্পরের পরিপূরক। সোনায় সোহাগা। অ্যারালভাইট দিয়ে আমার সঙ্গে সেঁটে রয়েছেন। আপনি সেই সোনার কেল্লার সময় থেকেই। আমাকে ছাড়া আপনার অস্তিত্বই নেই—অ্যান্ড ভাইসি ভারসা।
লালমোহনবাবু আমার দিকে ফিরে গভীর গলায় বললেন, বি ভেরি কেয়ারফুল, তপেশ! এটা বলার কোনও দরকার ছিল না, কারণ ফেলুদা স্পষ্টই বুঝিয়ে দিয়েছে যে, এবার থেকে কেয়ারফুল হবার অর্ধেক দায়িত্ব ওর।
কথার ফাঁকে ফেলুদা একটা চারমিনার ধরিয়েছিল। এবার সেটা আধাপোড়া অবস্থায় অ্যাশ-ট্রেতে ফেলে দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে পিঠে একটা চাপড় মেরে বলল, সোজা নিয়ম, বুঝলি তোপ্সে। এবার থেকে আমার গ্রিন সিগন্যাল না পাওয়া পর্যন্ত তুই হাত পা গুটিয়ে বসে থাকিবি। ঠিক হ্যায়?
আমি হেসে মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলাম ঠিক হ্যায়।
০২. গ্রিন সিগন্যাল
এই যে এতক্ষণ পঁয়তারা করলাম, তা থেকে বোঝাই যাবে যে, ফেলুদা আমায় গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছে। শুধু ফেলুদা কেন, নয়নের মামলা নিয়ে লিখছি শুনে জটায়ু একটা কান-ফাটানো হাততালি দিয়ে বললেন, গ্রেট! গ্রেট! ইয়ে, আমার ভূমিকাটা ইনট্যাক্ট থাকবে তো? সব কিছু মনে আছে তো? আমি বললাম, কোনও চিন্তা নেই; সব নোট করা আছে।
আসল মামলায় পৌঁছতে অবিশ্যি আরও কিছুটা সময় লাগবে। কোথায় শুরু করব জিজ্ঞেস করাতে ফেলুদা বলল, তরফদারের শো। দ্যাট ইজ দ্যা স্টার্টিং পয়েন্ট। আমি ওর কথামতোই স্টার্ট করছি।
তরফদার হলেন ম্যাজিশিয়ান। পুরো নাম সুনীল তরফদার। শোয়ের নামচমকদার তরফদার। আজকাল ব্যাঙের ছাতার মতো ম্যাজিশিয়ান গজাচ্ছে এই পশ্চিম বাংলায়। এর মধ্যে কিছু আছে যারা সত্যিই ম্যাজিক নিয়ে সাধনা করে। প্রতিদ্বন্দ্বিতার চাপে অনেককেই শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে আসতে হয়। যারা টিকে থাকে তাদের মোটামুটি একটা স্ট্যান্ডার্ড আছে। ইয়াং বয়সে ফেলুদার ম্যাজিকের নেশা ছিল, সেটা আমিই একটা গল্পে জানিয়ে ফেলেছিলাম। ফলে এ সব উঠতি ম্যাজিশিয়ানদের অনেকেই ওর কাছে আসে শোয়ে নেমন্তন্ন করার জন্য। আমরা কয়েকবার গিয়েছি, আর গিয়ে হতাশ হইনি।
সুনীল তরফদারও এই উঠতিদের মধ্যে একজন। বছর খানেক হল শো করছেন। এখনও তেমন নাম করেননি, যদিও দু-একটা কাগজে বেশ প্রশংসা বেরিয়েছে। গত ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে এক দিন সকালে ইনি আমাদের বাড়িতে এসে ফেলুদাকে টিপ করে এক প্রণাম করলেন। কেউ ওর পায়ে হাত দিলে ফেলুদা ভীষণ বিব্রত হয়ে পড়ে; তরফদারের প্রণামে ও হাঁ হাঁ করে উঠল।
ভদ্রলোকের বয়স ত্রিশ-বিক্রিশের বেশি নয়, লম্বা একহারা চেহারা, ঠোঁটের উপরে একটা সরু সাবধানে-ছটা গোঁফ। প্ৰণাম সেরে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, স্যার, আমি আপনার একজন গ্রেট ফ্যান। আমি জানি এককালে আপনার নিজেরই ম্যাজিকের শখ ছিল। আমার শো হচ্ছে মহাজাতি সদনে। আপনাদের জন্য তিনটে ফাস্ট রোয়ের টিকিট দিয়ে যাচ্ছি। আগামী রুবিধার সাড়ে ছুটয় যদি আপনার আসেন তা হলে আমি সত্যিই খুশি হব।
ফেলুদা তৎক্ষণাৎ হ্যাঁ না কিছুই বলছে না দেখে ভদ্রলোক ঝুঁকে পড়ে ফেলুদার কাঁধে হাত রেখে বললেন, আমি আপনাদের রোববার ডাকছি। এই কারণে যে, সেদিন আমার প্রোগ্রামে একটা নতুন আইটেম অ্যাড করছি। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি এ জিনিস আর কেউ কখনও স্টেজে দেখায়নি।
ফেলুদা যাব বলে কথা দিয়েছিল। রবিবার বিকেলে সাড়ে পাঁচটায় লালমোহনবাবু তাঁর সবুজ অ্যাশ্বাসাড়র নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে এলেন। চা-ডালমুট খেয়ে আমরা ছ। টায় রওনা হয়ে শোয়ের ঠিক পাঁচ মিনিট আগে মহাজাতি সদনে পৌঁছে গেলাম। কাগজে বেশ চোখে পড়ার মতো একটা বিজ্ঞাপন দুদিন আগেই বেরিয়েছিল, ভিড় দেখে মনে হল সেটায় কাজ দিয়েছে। আমরা মাঝের প্যাসেজ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে সামনের সারির মাঝামাঝি পাশাপাশি তিনটে চেয়ারে বসলাম।