গোলমেলে ঘটনা যা ঘটে সেটা দ্বিতীয় দিনে, আর সেটার কথা ভাবলেই মনে বিস্ময়, আতঙ্ক, অবিশ্বাস—সব একসঙ্গে জেগে ওঠে।
***
গাইডবুক পড়ে জেনেছিলাম মহাবলীপুরম ম্যাড্রাস থেকে প্রায় আশি কিলোমিটার দূরে। রাস্তা নাকি ভাল, যেতে দু ঘণ্টার বেশি সময় লাগা উচিত নয়। কালকের মতোই দুটো ট্যাক্সির ব্যবস্থা করেছিলেন শঙ্করবাবু। এবার নয়ন তরফদারের সঙ্গে না গিয়ে আমাদের সঙ্গে আসতে চাইল। কারণ আর কিছুই নয়, জটায়ুর সঙ্গে ওর বেশ জমে গেছে। ভদ্রলোক নয়নকে তাঁর লেটেস্ট বই অতলান্তিক আতঙ্ক-র গল্প সহজ করে বলে শোনাচ্ছেন। একবারে তো শেষ হবার নয়, তাই খেপে খেপে শোনাচ্ছেন। গাড়িতে তাই ফেলুদা আর জটায়ুর মাঝখানে বসল নয়ন। আর আমি সামনে।
যেতে যেতে বেশ বুঝতে পারছি, আমরা ক্ৰমে সমুদ্রের দিকে এগোচ্ছি। মাদ্রাজ শহর সমুদ্রের ধারে হলেও আমরা এখন অবধি সমুদ্র দেখিনি, তবে সন্ধেবেলা সমুদ্রের দিক থেকে আসা হাওয়া উপভোগ করেছি।
সোয়া দু ঘন্টার মাথায় সামনের দৃশ্যটা হঠাৎ যেন ফাঁক হয়ে গেল। ওই যে দূরে গাঢ় নীল জল, আর সামনে বালির উপর ছড়িয়ে উচিয়ে আছে সব কী যেন।
আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়ে বুঝলাম যে সেগুলো মন্দির। মূর্তি আর বিশাল বিশাল পাথরের গায়ে খোদাই করা নানারকম দৃশ্য।
আমাদের গাড়ি যেখানে এসে থামল, তার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে একটা ভ্যান। আর তার পরেই একটা প্ৰকাণ্ড লাক্সারি কোচ। কোচে একে একে উঠছে এক বিরাট টুরিস্ট দল। তাদের দেখেই কেন জানি বোঝা যায়। তারা আমেরিকান। কত রকম পোশাক, কত রকম টুপি, চোখে কতরকম ধোঁয়াটে চশমা, কাঁধে কত রকম ঝোলা।
বিগ বিজনেস, টুরিজম, বলে জটায়ু নয়নকে নিয়ে গাড়ি থেকে নামলেন।
ফেলুদা আগে এখানে না এলেও, কোথায় কী আছে সব জানে। ও আগেই বলে রেখেছিল—অনেক দূর ছড়িয়ে অনেক কিছু দেখার জিনিস আছে; তবে নয়নকে নিয়ে তো আর অত ঘোরা যাবে না; তুই অন্তত চারটি জিনিস অবশ্যই দেখিস—শোর টেম্পল, গঙ্গাবতরণ, মহিষমণ্ডপ গুহা আর পঞ্চপাণ্ডব গুহা। জটায়ু যদি দেখতে চান তো দেখবেন; না হলে নয়নকে সামলাবেন। তরফদার। আর শঙ্কর কী করবে। জানি না; কথাবার্তা শুনে তো মনে হয় না। ওদের মধ্যে শিল্পপ্রীতি বলে কোনও বস্তু আছে।
আমরা গাড়ি থেকে নেমে সামনে এগোনোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লালমোহনবাবু একটা জটায়ু মার্কা প্রশ্ন করলেন।
এ তো বল্লভদের কীর্তি, তাই না মশাই?
ফেলুদা তার গলায় একটা বাজখাই টান এনে বলল, পল্লব, মিস্টার গাঙ্গুলী, পল্লব। নট বল্লভ।
কোন সেঞ্চুরি?
সেটা খোকাকে জিজ্ঞেস করুন, বলে দেবে।
লালমোহনবাবু অবিশ্যি সেটা আর করলেন না; খালি মৃদুস্বরে একবার সজারু বলে চুপ। করে গেলেন। আমি জানি মহাবলীপুরম সপ্তম শতাব্দীতে তৈরি হয়েছিল।
প্রথমেই শোর টেম্পল বা সমুদ্রের ধারের মন্দিরটা দেখা হল। মন্দিরের পিছনের পাঁচিলের গায়ে ঢেউ এসে ঝাপটা মারছে।
এরা স্পট সিলেক্ট করতে জানত মশাই, ঢেউয়ের শব্দের উপরে গলা তুলে মন্তব্য করলেন জটায়ু।
ডান পাশে দূরে একটা হাতি আর একটা ষাঁড়ের মূর্তির পাশে কয়েকটা ছাট ছাট মন্দিরের মতো জিনিস রয়েছে। ফেলুদা বলল সেগুলো পাণ্ডবদের রথ। — যেটা দেখতে কতকটা বাংলার গাঁয়ের কুঁড়ে ঘরের মতে, সেটা হল দ্ৰৌপদীর রথ।
মাথা ঘুরে গেল গঙ্গাবতরণ দেখে। এটাকে অবিশ্যি অৰ্জ্জুনের তপস্যাও বলা হয়। বাইরেই রুয়েছে ব্যাপারটা, আর বোঝাই যায় যে একটা বিশাল পাথরের স্ল্যাব দেখে শিল্পীদের এই দৃশ্য খোদাই করার আইডিয়া মাথায় আসে। দুটো বিরাট হাতি, আর তার চতুর্দিকে অজস্র মানুষের ভিড়।
লালমোহনবাবু নয়নকে নিয়ে এখনও আমাদের পাশেই ছিলেন, দৃশ্যটার দিকে চোখ রেখে বললেন, এ তো ছেনি-হাতুড়ির কাজ, তাই না?
হ্যাঁ, গম্ভীরভাবে বলল ফেলুদা। তবে ভেবে দেখুন-হাজার হাজার প্রাচীন ভাস্কর্যের নমুনা রয়েছে আমাদের সারা দেশ জুড়ে, দশ-বারো শতাব্দী ধরে সেগুলো তৈরি হয়েছে, অথচ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে দেখলেও তার সামান্যতম অংশেও একটিও হাতুড়ির বেয়াড়া আঘাত বা ছেনির বেয়াড়া অ্যাঙ্গেলের চিহ্ন পাবেন না। এ তো মাটি নয় যে, আঙুলের চাপে এদিক-ওদিক করে ত্রুটি সংশোধন হয়ে যাবে; পাথরের ত্রুটি শুধরানোর কোনও উপায়। নেই। এ যুগে সেই পারফেকশনের সহস্ৰাংশও আর অবশিষ্ট নেই! কোথায় গেল কে জানে!
তরফদার আর শঙ্করুবাবু এগিয়ে গিয়েছিলেন; ফেলুদা বলল, যা, তোরা গিয়ে পঞ্চপাণ্ডব আর মহিষমণ্ডপ গুহাগুলো দেখে আয়। আমি এটা আর একটু খুঁটিয়ে দেখছি। তাই সময় লাগবে।
ফেলুদার কাছ থেকে গাইড বুকটা চেয়ে প্ল্যান দেখে বুঝে নিলাম, গুহা দুটো দেখতে কোনদিকে যেতে হবে। লালমোহনবাবুকে মুখে বলে বুঝিয়ে দিলাম। তবে তিনি এখন মহাবলীপুরম ছেড়ে অতলান্তিকে চলে গেছেন, তাই আমার কথা কানো গেল কি না জানি না। না গেলেও, আমি এগোনোর আগেই তিনি গল্প শুরু করে নয়নকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন।
কিছু দূর গিয়ে ডাইনে ঘুরে দেখি, একটা কাঁচা রাস্তা পাহাড়ের গা দিয়ে ওপরে উঠে গেছে। প্ল্যান বলেছে এটা দিয়েই যেতে হবে। ঢেউয়ের আওয়াজ এখানে কম; তার চেয়ে বেশি জোরে শুনছি। লালমোহনবাবুর গলা। মনে হচ্ছে গল্প ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছচ্ছে।
একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি, পঞ্চপাণ্ডব গুহায় পৌঁছে গেছি। –অন্তত বাইরের সাইনবোর্ডে তাই বলছে। আমি ঢোকার আগেই জটায়ু নয়নকে নিয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে রাস্তা দিয়ে আরও উপরে উঠে গেলেন। বুঝলাম আশ্চর্য সব শিল্পের নমুনা লালমোহনবাবুর কাছে মাঠে মারা যাচ্ছে।